বিভিন্ন কারণে আমরা প্রতিনিয়ত ক্লান্তি অনুভব করি, তবে সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা ক্লান্তির এক নতুন উৎসের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তারা জানিয়েছেন, মানুষের দৈনন্দিন ঘুমের অনিয়ম এবং শরীরের প্রাকৃতিক ছন্দের সঙ্গে ভুল সামঞ্জস্যের কারণে তৈরি হচ্ছে এক অদৃশ্য ক্লান্তি, যার নাম ‘সামাজিক জেট ল্যাগ’। এ বিষয়ে নাসার ঘুম–বিশেষজ্ঞরা জরুরি সতর্কতা জারি করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের অভ্যন্তরীণ দেহঘড়ি বা সার্কাডিয়ান রিদম এবং বাস্তব জীবনের সময়সূচির মাঝে অসামঞ্জস্য তৈরি হলে প্রভাব পড়ে ঘুমে। লাখ লাখ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তারা রাতে দেরিতে ঘুমাতে যান বা ছুটির দিনে বেশি ঘুমান। এতে করে শরীরের প্রাকৃতিক ঘুমের ছন্দ নষ্ট হচ্ছে। এর ফলেই দেখা দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি ও নানা শারীরিক জটিলতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো, সকালের প্রাকৃতিক আলোয় শরীরকে জাগ্রত করা এবং একটি সহায়ক ঘুমের পরিবেশ তৈরি করা—এসব অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে শরীরের শক্তি ফিরে আসে এবং সার্বিক সুস্থতা বজায় থাকে।
অনেকের কাছেই ‘জেট ল্যাগ’ শব্দটি পরিচিত, যা সাধারণত এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে দীর্ঘ ফ্লাইটে ভ্রমণের পর দেখা দেয়। তবে এবার বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন লক্ষণ বিমানে না চড়েও মানুষ অনুভব করছে, আর এটাকেই তারা বলছেন ‘সামাজিক জেট ল্যাগ’।
এই ‘সামাজিক জেট ল্যাগ’ মূলত গড়ে ওঠে ছুটির দিনগুলোতে ঘুমের সময়সূচি হঠাৎ পরিবর্তনের কারণে। যেমন—সপ্তাহান্তে দেরি করে ঘুমানো বা দীর্ঘ সময় বিছানায় কাটানোর ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি বিভ্রান্ত হয়। এই ছন্দপতনের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, মনঃসংযোগে ঘাটতি এবং সামগ্রিক সুস্থতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নাসার গবেষক এরিন ফ্লিন-ইভান্স এবং র্যা চেল জ্যানসেন বহু বছর ধরে মানুষের ঘুম নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা মহাকাশচারীদের ঘুমের চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ করে শরীরের সার্কাডিয়ান ছন্দের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
মহাকাশে দিন-রাত্রির চক্র পৃথিবীর মতো নয়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা নভোচারীরা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১৬ বার সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখেন। ফলে তারা প্রচণ্ড ঘুম-সংক্রান্ত চাপে থাকেন। কিন্তু নাসার তৈরি বিশেষ কৌশল তাদের ঘুমকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানী জ্যানসেন বলেন, সপ্তাহান্তের অতিরিক্ত ঘুম শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে বাস্তব সময়সূচির সঙ্গে সঙ্গতিহীন করে তোলে। এতে ঘুমের গুণগত মান নষ্ট হয়। তিনি বলেন, ‘ঘুম বেশি হলেও সকালবেলা শরীর অলস লাগে, ঘুম যেনো পুরোপুরি হয়নি—এমন বোধ কাজ করে।
অন্যদিকে, ফ্লিন-ইভান্স বলেন, কর্মদিবসে অতিরিক্ত ঘুমের চেষ্টা শরীরের স্বাভাবিক ছন্দের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে, এবং ঘুমের সময়ে হঠাৎ পরিবর্তন শরীরের ঘড়িকে বিভ্রান্ত করে তোলে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যারা রাতজাগা অভ্যাসে অভ্যস্ত, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হন। তারা সপ্তাহজুড়ে অনিয়মিত ঘুমান এবং ছুটির দিনে বেশি ঘুমিয়ে ক্ষতিপূরণ দিতে চান। কিন্তু বাস্তবে এতে উপকার তো হয়ই না, বরং ঘুমের গুণমান খারাপ হয়, বিষণ্নতা বাড়ে এবং দেহ ও মন ক্রমাগত ক্লান্তির দিকে ধাবিত হয়।
এই ঘুমজনিত ক্লান্তি দীর্ঘমেয়াদে শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে, এই অভ্যাসের ফলে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন, উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মতো সমস্যা তৈরি হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক জেট ল্যাগে আক্রান্তরা কর্মদিবসে ছুটির দিনের তুলনায় খারাপ ঘুমান। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া, মনঃসংযোগ ও প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় কমে যায়।
তবে আশার কথা, এই সমস্যা সমাধানে রয়েছে কার্যকর উপায়। নাসার ঘুম–বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, ঘুমের অভ্যাসে একটি সুশৃঙ্খল রুটিন তৈরি করতে হবে এবং সার্কাডিয়ান ছন্দে ভারসাম্য ফেরাতে হবে।
বিজ্ঞানী র্যা চেল জ্যানসেন বলেন, ঘুমের সময় নির্ধারণে শরীরের ওপর আস্থা রাখতে হবে। কয়েক দিনের জন্য অ্যালার্ম ঘড়ি বাদ দিয়ে শরীরকে নিজে থেকে জেগে ওঠার সুযোগ দেওয়া উচিত।
আর ফ্লিন-ইভান্সের মতে, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই প্রাকৃতিক বা উজ্জ্বল আলোয় শরীরকে অভ্যস্ত করা উচিত। আলো হচ্ছে সার্কাডিয়ান ঘড়ির এক প্রধান নিয়ন্ত্রক। প্রতিদিন সকালের আলো শরীরের ছন্দ ঠিক রাখতে এবং সারাদিন সচল থাকতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল