ব্রিটিশ রাজপরিবারের বহুল আলোচিত জুটি রানী ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স আলবার্ট। এ দুজনকে নিয়ে সাধারণ মানুষের তো বটেই ইতিহাসবিদদেরও কৌতূহলের কমতি ছিল না। রানী ভিক্টোরিয়া বিভিন্ন কারণে আলোচিত ছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রিন্স আলবার্টের সঙ্গে তার অবাধ্য প্রেম। এই প্রেম নিয়ে বহু মিথ ছড়িয়ে আছে। বিশেষ করে এই যুগলের মধ্যে শুধু প্রেম নয় একই ধারায় চলেছে শীতল ক্ষমতার লড়াই। ব্রিটিশ রাজপরিবারের ১২শ বছরের ইতিহাসে তাই অনন্য মর্যাদা পেয়েছে এই প্রেম কাহিনী।
রানী ভিক্টোরিয়া সবার চেয়ে রূপে ও গুণে একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। তাই কিশোরী বয়সেই তিনি রাজ্য পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। রাজ্য শাসনের এই গুণ কাজে লাগিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি সিংহাসনে বসেন। রাজ্য ক্ষমতার অধিকারিণী হয়ে উঠেন তিনি। রানী ভিক্টোরিয়ার জন্ম ১৮১৯ সালের ২৪ মে। তার মা কিন্তু একজন জার্মান ডিউকের মেয়ে। যে কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিকারিণী হয়েও তিনি ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন না। ইংরেজির চেয়ে জার্মান ভাষায় সাবলীল ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও আরও বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কিশোরী রানীকে। বিশেষ করে রাজ সিংহাসনের উত্তারিধারী নিয়ে যে দীর্ঘ জটিলতা চলছিল তার সমাধান করতে হয়েছিল তাকে। সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি নিজেই যথাসময়ের আগেই রাজ্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এতে সাময়িকভাবে একটি সমস্যার সমাধান ঘটে।
ভিক্টোরিয়া ছিলেন রাজা জর্জের চতুর্থ সন্তান অ্যাডওয়ার্ডের একমাত্র মেয়ে। চাচা চতুর্থ উইলিয়াম মারা যাওয়ার পর ১৮৩৭ সালে ভিক্টোরিয়া ইংল্যান্ডের রানী নির্বাচিত হন। রানীকে তারপরই সচেতন হয়ে উঠতে হলো। তিনি প্রাথমিকভাবে যাদের সাহায্য পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লর্ড মেলবোর্ন। অল্প বয়স্ক রানীর সঙ্গে লর্ড মেলবোর্নের মেলামেশাকে অনেকেই আড়চোখে দেখছিল। একে তো লর্ড মেলবোর্ন ছিলেন বিপত্নীক তার ওপর তার বয়স তখন ৫৮ ছুঁয়েছে। অন্যদিকে ১৮ বছরের সুন্দরী রানী ভিক্টোরিয়া। এই দুজনের মেলামেশা বেশ ভালোভাবেই চলতে থাকে। প্রতিদিন লর্ড মেলবোর্ন কিশোরী রানীর কাছে ছুটে আসতেন। দিনের বড় একটি সময় কাটাতেন কিশোরী রানীর সঙ্গে। উইন্সডোর ক্যাসেলে দুজনের প্রতিদিন এই একান্তে সময় কাটানোর কথা রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৩৭ সালের বসন্তে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল ভিক্টোরিয়া বিয়ে করছেন মেলবোর্নকে। এই গুজব সত্যি নাকি মিথ্যা তা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য রানী ভিক্টোরিয়া এই সম্পর্কের নাম দিয়েছিলেন শুধুই বন্ধুত্ব। তিনি ব্যক্তিগত জার্নালে লিখেছিলেন মেলবোর্ন সৎ, বিশাল হৃদয়ের অধিকারী একজন মানুষ। এই গুজবের পর থেকে সাবধান হন রানী ভিক্টোরিয়া। তবে রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে লর্ড মেলবোর্নের বন্ধুত্ব খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ রানী শিগগিরই প্রেমে পড়েন। ১৮৩৯ সালের ঘটনা। জার্মানি থেকে রানীর চাচাতো ভাই প্রিন্স আলবার্ট ইংল্যান্ডে বেড়াতে আসেন। প্রিন্স আলবার্ট উচ্চবংশীয়, সাহসী যোদ্ধা ও সুদর্শন যুবক। ৫৮ বছর বয়সী লর্ড মেলবোর্নের চেয়ে প্রিন্স আলবার্ট ছিল অনেকাংশে আকর্ষনী। তাই অল্প সময়েই রানী তার প্রেমে পড়ে যান। প্রিন্স আলবার্টও এই প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। দুজনের লুকোচুরি প্রেম চলতে থাকে। কিন্তু ইতোপূর্বে উইন্সডোর ক্যাসেলে লর্ড মেলবোর্নের সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর গুজব কিন্তু রাজ্যে ছড়িয়ে ছিল। তাই নতুন করে কোনোরকম অপ্রীতিকর গল্প ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই বিয়ের প্রস্তুতি নিলেন এ জুটি। ১৮৪০ সালের ফেব্রুরিতে বিয়ে হয় তাদের। প্রেম থেকে সংসারের গল্প লিখতে থাকেন দুজনে। তবে এরই মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের সঙ্গে ঝামেলা বেঁধে যায় লর্ড মেলবোর্নের। তাই তিনি ১৮৪১ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এ ছাড়া ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব শুরু হয় লর্ড মেলবোর্ন ও রানী ভিক্টোরিয়ার মধ্যে। লর্ড মেলবোর্ন বরাবরই দেশের সাধারণ সমস্যা নিয়ে রানীর উদ্বেগকে নিরুৎসাহিত করতেন। রাজ্য পরিচালনায় রানীকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু রানী শুধু মেয়ে বলে একজন শাসকের এই দূরে সরে থাকার নীতিকে সমর্থন করতেন না। রানীর সঙ্গে লর্ড মেলবোর্নের বন্ধুত্ব তাই মিইয়ে গেল। অপরদিকে প্রিন্স আলবার্ট রাজ্য পরিচালনায় রানীকে আরও এগিয়ে আসার প্রেরণা দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে ইংল্যান্ডে শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। প্রিন্স আলবার্ট তাই রানীর মন জয় করতে পেরেছিলেন। সব মিলিয়ে রানী ভালোভাবেই দেশ চালাতে থাকেন। রানী জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে আত্দনিয়োগ করায় তিনি সাধারণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তাকে হেনস্তা হতে হয়েছিল। তার নাম লেডি ফ্লোরা। স্যার জন কনরির সঙ্গে লেডি ফ্লোরার অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। অবশ্য লেডি ফ্লোরা এটি তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তবু রানী ফ্লোরাকে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা বলে ঘোষণা দেন। পরে জল ঘোলা হয়ে ওঠে। কারণ মেডিকেল টেস্ট করার পর দেখা গেল ফ্লোরা অন্তঃসত্ত্বা নন, লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। লিভারে টিউমার থাকার কারণেই বাইরে থেকে অন্তঃসত্ত্বা মনে হতো ফ্লোরাকে। লেডি ফ্লোরার মৃত্যুর পর ব্রিটেনে রানী ভিক্টোরিয়ার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। চারদিক থেকে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। সাধারণ জনগণও এ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তাই রানীর জনপ্রিয়তা এবার কমতে শুরু করে। তবে ঘটনা মোড় ঘুরে যায় ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ দখল করে নেওয়ার পর। ১৮৭৭ সালে ভারতবর্ষ সরাসরি ইংল্যান্ডের অধীনে চলে আসলে রানী ভিক্টোরিয়াকে 'ভারতসম্রাজ্ঞী' উপাধি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের দখলে আসে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও আফ্রিকা মহাদেশের বিশাল অংশ। এ বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনভার তার হাতে থাকায় ভিক্টোরিয়া রানী থেকে হয়ে পড়েন মহারানী। ১৮৬১ সালের ডিসেম্বরে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স আলবার্ট। স্বামীর মৃত্যুর পর জন ব্রাউন নামের এক স্কটিশ ভৃত্যের সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তবে প্রিন্স আলবার্টের সঙ্গে সংসারের গল্পটায় অনেক রং মাখানো হয়েছে এরই মধ্যে। তার একটি ক্ষমতা আর প্রেমের দ্বন্দ্ব।