বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা
অত্যাচারী জমিদার থেকে বাউল সাধক

হাসন রাজা

সাইফ ইমন

হাসন রাজা

শিল্পীর তুলিতে অঙ্কিত হাসন রাজার একটি চিত্রকর্ম

মাত্র ১৫ বছর বয়সে জমিদারি শুরু করেন হাসন রাজা। যৌবনে ভোগ-বিলাসে মত্ত ছিলেন। বর্ষায় বজরা নৌকা সাজিয়ে গান-বাজনায় ঘুরে বেড়াতেন। এ সময় একের পর এক গান লিখতে থাকেন। বিলাসী জীবনের মাঝে আধ্যাত্মিক বোধের জন্ম নেয় তার মনে। ছেড়ে দেন জমিদারি। বিলাসী পোশাক ছেড়ে নেন সাধারণ পোশাক। অত্যাচারী জমিদার থেকে হয়ে ওঠেন এক বাউল সাধক।

 

বাংলা সাহিত্যে মরমি ধারা যুগ যুগ ধরেই বহমান রয়েছে। সাধারণভাবে মরমি বলতে বোঝানো হয় বিশ্বপ্রকৃতির মর্মে যিনি প্রবিষ্ট, তিনিই মরমি। মরমি সাধনা হাসন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। তিনি সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করেছেন। হাসন রাজার গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্ম বোধের জন্ম হয়। এক বোধ জন্ম নেয়। কবি জীবনানন্দ দাশ এই বোধের কথাই হয়তো বলতে চেয়েছেন এভাবে- ‘আলো অন্ধকারে যাই -মাথার ভিতরে / স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!/ স্বপ্ন নয় শান্তি নয় ভালোবাসা নয়, / হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!’

আবার হাসন রাজার দার্শনিকতার পরিচয় মেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। কবিগুরু প্রভাত কুমার শর্মার হাত ঘুরে হাসন রাজার গানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই গানগুলোর মাধ্যমেই কবিগুরু হাসন রাজাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘পূর্ব বঙ্গের একটি গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই। সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্বসত্য।’ ১৯২৫ সালে দর্শন কংগ্রেসের সভায় ও পরবর্তীকালে লন্ডন হিবার্ট বক্তৃতায় কবিগুরু হাসন রাজা সম্পর্কে এই বক্তব্য প্রদান করেন। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই হাসন রাজার মনে  বোধের আগুন জ্বলেছিল। তাই হাসন রাজা গানে গানে বলেন ‘আগুন লাগাইয়া দিল কনে’। হাসন রাজার নামের আগে মরমি শব্দটির সঙ্গে দার্শনিক শব্দটিও যুক্ত করতে কোনো বাধা নেই। হাসনের পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায়। বংশপরম্পরায় তারা হিন্দু ছিলেন। পরবর্তীতে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে সিলেটে এসে আবাস গড়েন। হাসন রাজার দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাসন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর, সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষ্মণছিরি পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে। হাসন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তার তৃতীয় পুত্র। আলী রাজা তার খালাতো ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাসন রাজার জন্ম। পরবর্তীতে হাসন রাজার অনেক কবিতা ও গানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধন পাওয়া যায়। হাসনের দাদার মৃত্যুর পর তার বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সব সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলী রাজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। অপরিপক্ব বয়সে এত সম্পদের মালিক হয়ে হাসন রাজা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগ-বিলাসী এক শৌখিন জমিদার। এ বিষয়টি হাসন রাজা নিজেই এক গানে উল্লেখ করেছেন, ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া’। বর্ষা মৌসুমে বজরা  নৌকা সাজিয়ে গান-বাজনার আয়োজন করে হাসন রাজা চলে যেতেন এবং বেশ কিছু কাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখতেন। এরই মধ্যে তিনি প্রচুর গান রচনা করে ফেলেন, এসব গান নৃত্য এবং বাদ্য সহকারে গাওয়া হতো। আশ্চর্যের বিষয় যে, বিলাসী জমিদারই একসময় পরিবর্তিত হয়ে যান। হাসন রাজার মধ্যে ধীরে ধীরে এক আধ্যাত্মিক বোধের জন্ম নিতে থাকে। যা তার স্বপ্ন ও জীবন দর্শনে আমূল প্রভাব ফেলে। তার মনের দুয়ার খুলে যায়। বেপরোয়া জমিদার থেকে তার চরিত্রে এক শান্ত ভাব চলে আসে। বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি সাদামাটা জীবন বেছে  নেন। জমকালো পোশাক ত্যাগ করে সাধারণ  পোশাক পরতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি  গেয়ে উঠলেন, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নামরে, না করলাম তার কাম।’ তার বহিঃজগৎ ও অন্তর্জগতে আসে বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তার এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের বৈরাগ্য তৈরি হয়।

হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা হাসন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন। এ ছাড়াও সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়ি।

 

বৈরাগ্যের সূচনা...

হাসন রাজা নাইওরি নৌকায় হামলা করতেন। নৌকা থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতেন। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হাসন রাজার মা   নাইওরি নৌকায় নিজেকে তার শিকার হিসেবে উপস্থাপন করেন। হাসন রাজা যখন দেখলেন তার নিজের মা-কে তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন তখন লজ্জা পেয়ে হাসন রাজা এ পথ থেকে ফিরে আসেন।  হাসন ক্ষমা চেয়ে মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েন। এর পরই তার মধ্যে বৈরাগ্যের সূচনা হয়েছিল। আবার অনেকের মতে, ঘটনাটি এরকম যে হাসন রাজা পশু-পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। ঘোড়াও পুষতেন হাসন। তার প্রিয় দুটি ঘোড়ার একটি হলো জং বাহাদুর, আরেকটি চান্দমুশকি। এরকম আরও ৭৭টি ঘোড়ার নাম পাওয়া গেছে ইতিহাসবিদদের মতে। হাসন রাজার আর এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে রুপার টাকা ছড়িয়ে দেওয়া। বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত, তা দেখে তিনি খুব মজা পেতেন। পশু-পাখির যত্ন ও লালন-পালনের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন আসাম এবং সিলেট এলাকায় ৮.৮ রিখটার স্কেলের এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মানুষসহ অনেক পশু-পাখি প্রাণ হারায়। পরে এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে হাসন রাজা দেখলেন তার অনেক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। খাদ্যের অভাবে হাসনের অনেক পশু-পাখির মৃত্যু হয়েছে। এরপর তার মনে জীবন সম্পর্কে কঠিন বৈরাগ্যের সূচনা করে। হাসন রাজার প্রথম জীবনের কালো অধ্যায়ের ইতি ঘটে। আবার অনেকে বলে থাকেন একদিন হাসন রাজা একটি আধ্যাত্মিক স্বপ্ন দেখলেন এবং এরপরই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করলেন। বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করলেন। তবে যেভাবেই পরিবর্তন ঘটুক না কেন এরপর থেকে হাসন রাজা নিয়মিত প্রজাদের খোঁজখবর রাখা থেকে শুরু করে এলাকায় বিদ্যালয়, মসজিদ এবং আখড়া স্থাপন করেন। সেই সঙ্গে চলতে লাগল গান রচনা। তার অন্তর্জগতেও বিরাট পরিবর্তন আসে। অত্যাচারী জমিদার থেকে বনে গেলেন বাউল সাধক। সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নেওয়া হয়ে উঠল তার প্রতিদিনের কাজ। সেই সঙ্গে চলতে থাকে গান রচনা।

 

ভোগ-বিলাসে মত্ত ছিলেন

ভোগ-বিলাসী ও শৌখিন হাসন রাজা যৌবনের শুরুতে রমণীসম্ভোগে ছিলেন অক্লান্ত। এ নিয়ে নানারকম লোককথা প্রচলিত রয়েছে। তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া।’ সেই সময় স্থানীয় পুকুরঘাটে স্নানরত গ্রামের মেয়েরা ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনলেই ভয় পেয়ে পানির নিচে ডুব দিত। হাসন রাজার চোখে পড়লেই আর রক্ষা নেই। তুলে নিয়ে যেতেন হাসন। আবার নাইওরি নৌকায় হামলা করতেন। নৌকা থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতেন। এতদিন হাসন রাজা পুকুরঘাটের পাশ দিয়ে আসার সময় গ্রামের আরেক মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় এবং তার রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজের গলার মালা ছুড়ে দেন আর গেয়ে ওঠেন, ‘সোনা বন্দে আমারে দেওয়ানা বানাইল, দেওয়ানা বানাইল  মোরে পাগল করিল।’ আরেকবার পিয়ারীর প্রেমে পড়েছিলেন হাসন রাজা। পিয়ারী ছিলেন লখনৌ থেকে আসা একজন বাইজি। তিনিও খুব সুন্দরী ছিলেন। এই পিয়ারীর প্রেমে পড়ে হাসন

গেয়েছিলেন, ‘নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে/ হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলো রে।’ তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন দিলারামকে। দিলারামও হাসন রাজাকেই তার সর্বস্ব মানতেন। দুজনের প্রেম ভালো জমেছিল। কিন্তু বাদ সাধেন হাসন রাজার মা। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তার মা দিলারামকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেন। কিন্তু দিলারাম বলেছিলেন, ‘আমি চলে গেলে অঘটন ঘটে যাবে মা’ এবং এর পরপরই হাসন রাজা বাইজিবাড়ি আর শরাবে ডুবে থাকতেন।

 

দর্শন

বৈরাগ্যভাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাসন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব  সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। অত্যাচারী নিষ্ঠুর শাসক থেকে হয়ে গেলেন সাধক। একসময় তিনি গেয়ে উঠেছিলেন- ‘ও  যৌবন ঘুমেরই স্বপন সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন’।     এর মধ্যেই আছে আত্মোপলব্ধির এক মরমি পর্যায়। আর এর ভিতরেই আমরা খুঁজে পাই দার্শনিক হাসন রাজাকে। হাসন রাজা সিলেটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে সম্রাট অশোকের যেমন বোধোদয় হয়েছিল, ছেলেবেলার সেই ভূমিকম্প হাসন রাজার চিন্তারও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। হাসন রাজা প্রেমিক ছিলেন। একসময় তার প্রেমের গভীরতা মহাকাল স্পর্শ করে। হাসন রাজার গানগুলো শুনলেই আমরা দেখতে পাই আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। হাসন রাজার কাছে মনে হয়েছে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। জগৎ নশ্বর। কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থ দুঃখকে জয় করার জন্য এরকম পরিস্থিতিতে ঘর ছেড়েছিলেন। রাজকুমার বহু বছরের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। কিন্তু হাসন রাজা সংসার ত্যাগ করেননি। বরং সংসারে থেকেই তার দার্শনিক ভাবনার ভিতর দিয়ে ঘরে থেকেই পেয়ে গেছেন তার অন্তর্লোকের বন্ধুকে। কবি নজরুল গানে গানে যাকে বলেছেন, ‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর।’ এই মনোহরের কাছেই হাসন পেয়েছিলেন তার সব প্রশ্নের জবাব। অন্তরের নূরের ঝলক মনের চোখ দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এরপর থেকেই তিনি মরমি কবি।

 

হাসন রাজার জাদুঘর

হাসন রাজা জাদুঘর সিলেটের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে অবস্থিত। এই মরমি কবির বাসভবনই বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই জাদুঘরের উদ্দেশ্য হচ্ছে হাসন রাজাকে কেন্দ্র করে রাজা পরিবারের স্মৃতি সংরক্ষণ করা। লোকসংস্কৃতি এবং ইতিহাসের ওপর গবেষণা কার্যক্রমকে এই জাদুঘর অনুপ্রাণিত করে থাকে। জাদুঘরটি দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে শিক্ষাবিদ দেওয়ান তালিবুর রাজা ট্রাস্ট। দেওয়ান তালিবুর রাজা হাসন রাজার প্রপৌত্র। হাসন রাজাকে কেন্দ্র করেই সাজানো হয়েছে পুরো জাদুঘরটি। রাজাকুঞ্জ হচ্ছে শতবর্ষী পুরাতন টিনশেডের দালান যাতে অল্প কয়েকটি কক্ষ আছে। প্রধান ফটকের কয়েক মিটার পরেই জাদুঘরের অবস্থান। দর্শনার্থীদের প্রবেশপথে হাসন রাজা এবং তার পুত্র একলিমুর রাজা চৌধুরীর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। জাদুঘরটিতে দুটি গ্যালারি আছে। প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক দর্শনার্থী জাদুঘরটিতে আসেন। এর বাইরে শুক্র ও শনিবার সিলেটে যখন পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে তখন বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী হাসন রাজার সৃষ্টি ও জীবনকে জানতে জাদুঘরে আসেন। জাদুঘরে প্রাচীন বইপুস্তক ও হাসন রাজার ব্যবহৃত অনেক সামগ্রী রয়েছে। এ ছাড়াও অনেক গবেষকও এখানে নিয়মিত কাজ করতে আসেন।

 

গানের রাজা

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হাসন রাজা রচিত ২০৬টি গান নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিন পুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, হাসন রাজার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ ‘শৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয় ছিল- ‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। হাসন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব কেউই বলতে পারেননি। সৈয়দ মুর্তজা আলীর ‘মরমি কবি হাসন রাজা’ রচনায় এক জায়গায় হাসন রাজার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘হাসন রাজা সুনামগঞ্জের একজন মুকুটহীন রাজা ছিলেন। হাসন রাজা সম্পর্কে বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান  মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, রাজা সুলভ সত্তায় একটি অতি কোমল দয়ালু মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জের আরেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক গবেষক আবদুল হাই রচনা করেছেন ‘হাসন পছন্দ’ নামে একটি গ্রন্থ। ইদানীং হাসন রাজার উত্তর পুরুষদের অনেকের লেখার মধ্যে হাসন রাজা সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। হাসন রাজার গানে আধ্যাত্মিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি যে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে বাঁধা ঘুড়ি সে  কথাও ব্যক্ত হয়েছে-

“গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি।

হাসন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি।

মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।

জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।’’

অনেকে দাবি, ঈশ্বরানুরক্তি, জগৎজীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই তার গানে প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। গানে গানে হাসন রাজা অদৃশ্য এক মহাশক্তির কথা বলেছেন বার বার। এই মহাশক্তি কেবল অনুভবের যোগ্য। শুধু তৃতীয় নয়ন খুললেই তাকে দেখা যায়। কিন্তু হাসন রাজা সংসারের মায়ায় বাঁধা পড়েছিলেন, তাই বলেন, ‘স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল। কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল।’ এই আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোপলব্ধির ভিতর দিয়েই হাসন রাজা মরমি-সাধন-লোকের সন্ধান পেয়েছিলেন।

হাসন রাজা জাগতিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করে গেছেন। হাসন রাজার সংগীত, সাধনা ও দর্শনে এই তিন

 চেতনার প্রতিফলন আছে। হাসন লিখেছেন-

আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,

হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।

আবার হাসনই বলেন, ‘হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা’। স্পষ্টই হাসন রাজার সংগীতে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পুরাণ ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন লালন ও অন্যান্য মরমি সাধকের সমমনা। হাসন রাজার কোনো গুরুর নামোল্লেখ নেই। কেউ কেউ বলেন, তিনি চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। হয়তো তার গুরু কেউ ছিলেন। যিনি আড়ালেই রয়ে গেছেন। সুফিতত্ত্বের বর্ণনা ও প্রভাব হাসনের সংগীত ও দর্শনে ভালোভাবেই রয়েছে। সুফিমতের সঙ্গে দেশীয় লোকায়ত মরমি ধারা ও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনের সমন্বয়ে তার সাধনার পথ নির্মিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর