বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ইরাক-ইরানে যুদ্ধের ইতিহাস

সাইফ ইমন

ইরাক-ইরানে যুদ্ধের ইতিহাস

ইরাক এবং ইরানের রয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস। দেশ দুটি নিজেদের মধ্যেও যুদ্ধ শুরু করে ১৯৮০ সালে। সেপ্টেম্বরের একদিনে সাদ্দাম হোসেন ইরানে সৈন্য পাঠালেন। তারপর সেই লড়াই বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম যুদ্ধগুলোর একটিতে রূপ নিয়েছিল। অমীমাংসিতভাবে এই যুদ্ধ শেষও হয়েছিল। কালক্রমে ইরাকে আগ্রাসন চালায় যুক্তরাষ্ট্র।

সর্বসাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ইরানের সঙ্গেও মার্কিন বৈরিতা তীব্র হয়ে উঠেছে। যার ফলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা : মধ্যপ্রাচ্য এগিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধের দিকে।  

 

ইরাক-ইরান যুদ্ধ

ইরান-ইরাক যুদ্ধের সূচনা ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এর অবসান ঘটে। ইরানের কাছে এ যুদ্ধ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ এবং পবিত্র প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এ যুদ্ধকে ব্যাটল অব ক্বাদেসিয়া নামে অভিহিত করতেন। সীমান্ত বিরোধ এবং ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া জঙ্গিদের ইরানি মদদ দেওয়ার অভিযোগে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বাহিনী পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অবৈধভাবে ইরানি ভূখন্ডে আক্রমণ এবং অনুপ্রবেশ চালায়। সদ্য ঘটে যাওয়া ইরানি ইসলামী বিপ্লবের নাজুক অবস্থাকে ব্যবহার করে ইরাক যুদ্ধে দ্রুত অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কার্যত সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৮২ সালের জুনের মধ্যে ইরান তার হারানো সব ভূখন্ড  পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরের ৬ বছর ইরানি বাহিনী যুদ্ধে অগ্রসর ভূমিকায় ছিল। জাতিসংঘের বারবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। ২০০৩ সালে দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধবন্দী বিনিময় ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কৌশলের সঙ্গে এ যুদ্ধের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পরিখা, কাঁটাতার, মানব স্রোত, বেয়োনেট চার্জ এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ইরাকি বাহিনী ইরানি সৈন্য, বেসামরিক নাগরিক এবং ইরাকি কুর্দিদের ওপর রাসায়নিক গ্যাস এবং মাস্টারড গ্যাস প্রয়োগ করে।

 

ইরাকে  মার্কিন আগ্রাসন

মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাকে বোমা হামলা শুরু করেছিল। সেই আগ্রাসন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আগ্রাসনের প্রায় ১৮ বছর হতে চলেছে। ১ হাজার মার্কিন টোমাহক-রকেট ইরাকের আকাশের দখল নিয়েছিল ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ‘চূড়ান্ত ইনসাফ প্রতিষ্ঠা’র (অপারেশন ইনফিনিট জাস্টিস) ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় মধ্য রাতে বাগদাদ জেগে উঠেছিল বোমার শব্দে। গত ১৫ বছরে হারিয়ে গেছে আনুমানিক ৩৪ লাখ মানুষ। ইরাক আগ্রাসনের ১৬ বছরে এসে প্রায় অর্ধেক মার্কিনি (৪৮%) মনে করছে, সামরিক হস্তক্ষেপ ভুল ছিল। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে উঠে এসেছে এই তথ্য। ২০০৩ সালে যুদ্ধকালীন পরিচালিত জরিপে মাত্র ২২ শতাংশ মানুষ সে সময় যুদ্ধকে ভুল বললেও এতে সমর্থন ছিল ৭১ শতাংশ মার্কিনির।

 

 

সোলাইমানির মৃত্যু

গত শুক্রবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের এক হামলায় ইরানের কুদস বাহিনীর ক্ষমতাধর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশেই সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যাকান্ডের পর ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে।

 

ট্রাম্পের মাথার মূল্য

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথার দাম ৮ কোটি ডলার ঘোষণা করা হয়েছে। ইরানের মাশহাদ শহরে জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। বিক্ষোভ-সমাবেশের আয়োজকরা বলেন, ইরানের আট কোটি জনগণের প্রত্যেকে এক ডলার করে দান করলে তা আট কোটি ডলারে দাঁড়াবে।

 

ট্রাম্পের হুমকি

ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলে আমেরিকা সে দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর হুমকি দিয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন সব পক্ষের উদ্দেশ্যে সংযমের ডাক দিয়েছে। বাগদাদে কাসেম সোলাইমানি হত্যাকা-ের পর ইরাকের মাটিতে আমেরিকা ও ইরানের সংঘাতের পরিণতি ইরাকের বর্তমান শাসকদের জন্য চরম অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

পেন্টাগনের বোমারু

ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে ডিয়েগো গার্সিয়া সামরিক ঘাঁটিতে ছয়টি বি-৫২ বোমারু বিমান পাঠাচ্ছে পেন্টাগন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনা পেলে সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো তেহরানে আঘাত হানবে। তবে ইরানের ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আওতার বাইরে ওই বিমানগুলো মোতায়েন করা হচ্ছে। নির্দেশনা পেলেই ইরানের বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করবে।

 

ইরানের সামরিক শক্তি

জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার জেরে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই হত্যাকা-ের পর আমেরিকার ওপর কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছে।

এমন অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। সামরিক শক্তিতে ইরানের অবস্থান ১৪তম। মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির অবস্থান খুবই শক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকে একহাত নেওয়ার ক্ষমতা আছে ইরানের।

ইরানের বর্তমান সক্রিয় সেনাসদস্য পাঁচ লাখ ২৩ হাজার। এছাড়া সংরক্ষিত সদস্য রয়েছে তিন লাখ ৫০ হাজার জন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মতে, কমপক্ষে দেড় লাখ ইসলামিক রিভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি সেনা আছে দেশটিতে। আইআরজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৪০ বছর আগে যা পরে বড় মিলিটারি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এটাকে ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফোর্স বলে মনে করা হয়। দেশটির ট্যাংকের সংখ্যা এক হাজার ৬৩৪টি। সাঁজোয়া যানের (আর্মড ফাইটিং ভেহিকল) সংখ্যা দুই হাজার ৩৪৫টি। সেনাসদস্যের ব্যবহারের জন্য কামান (টোয়েড আর্টিলারি) রয়েছে দুই হাজার ১২৮টি। পাশাপাশি ৫৭০টি স্বয়ংক্রিয় কামান (সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি) ও এক হাজার ৯০০টি রকেটচালিত কামান (রকেট আর্টিলারি) রয়েছে। আর ইরানের বিমানবাহিনীর মোট আকাশযানের সংখ্যা ৫০৯টি। এর মধ্যে রয়েছে-- ফাইটার বিমান ১৪২টি, অ্যাটাক বিমান ১৬৫টি, হেলিকপ্টার ১২৬টি ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার ১২টি। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য ১০৪টি ও পরিবহনের জন্য ৯৮টি উড়োজাহাজ রয়েছে বাহিনীটির। ইরানের হাতে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত কোনো স্টিলথ ফাইটার বিমান নেই।  ইরানের নৌবাহিনীতে এখন পর্যন্ত যোগ হয়নি কোনো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। বাহিনীটিতে ফ্রিগেট রয়েছে ছয়টি, করভেট রয়েছে তিনটি এবং সাবমেরিন রয়েছে ৩৪টি। নেই কোনো ডেস্ট্রয়ার। তবে ইরানের ৮৮টি পেট্রোলবোট ও তিনটি মাইন ওয়্যাফেয়ার রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক বোমা নেই বলে ধারণা করা হয়। ইরানের কুদস ফোর্স যার নেতৃত্বে ছিলেন সেটি বিদেশে অনেক গোপন অভিযান পরিচালনা করে।

 

ইরাক যুদ্ধ

২০০৩ সালের ২০ মার্চ রাজধানী বাগদাদের ওপর বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল ইরাক যুদ্ধ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ওই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে এখনো ইরাকে শান্তি ফিরে আসেনি। ২০ মার্চ বৃহস্পতিবার ইরাকি সময় ভোর ৪টায় রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে বোমাবর্ষণের মাধ্যমে শুরু হয় ইরাকের ওপর মার্কিন আক্রমণ। এক হাজার টোমাহক-রকেটের সাহায্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ চালাল ইরাকের বিভিন্ন স্থাপনার ওপর। যুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতা খর্ব করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাছাই লক্ষ্যস্থলে আক্রমণ শুরু করে।

মধ্যপ্রাচ্যের তেলের দিকে নজর যুক্তরাষ্ট্রের বহু আগে থেকেই। বিশ্ব চলে তেলের দামে। তেল অর্থনীতি চালায়। বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি ইরাক। খুব সহজ অঙ্ক, ইরাক-ইরান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পক্ষ নিয়ে লড়েছিল। তখন ইরাক-যুক্তরাষ্ট্র গলায় গলায় ভাব। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরল যখন সাদ্দাম হোসেন তার দেশের তেল দেশের উন্নয়নেই লাগাতে চাইলেন। ইরাকের তেল শুধু নিজের দেশের জন্য নয়, মধ্যপ্রাচ্যে জাতীয়করণের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন সাদ্দাম। তখনই বাধে ঝামেলা।

 

ইমাম খোমেনির ক্ষমতা দখল

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের নায়ক ইমাম খোমেনি (রহ.) ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী একজন নেতা। প্রথমত তিনি ছিলেন একজন ইসলামী নেতা, দ্বিতীয়ত ইরানের জনমানুষের নেতা। তিনি প্রথম গোটা বিশ্বের নজর কাড়েন ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে। তখন ইরানের শাহ মুহাম্মদ রেজা পাহলভির বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনির ঘোষিত যুদ্ধ এবং আমেরিকাবিরোধী কঠোর বক্তব্য তাকে বিশ শতকের অন্যতম বিপ্লবী চরিত্রে পরিণত করে। ১৯৬৩ সালে ইমাম খোমেনি তৎকালীন শাহ সরকারের অত্যাচার, নিপীড়ন নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এক সময় রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। দিনটি ছিল ইরানের ইতিহাসে বিশেষ অর্থবহ। শাহ রাজতন্ত্রের পতনের পর ইরানের ভূমিতে পদার্পণ করেন ১৪ বছরের নির্বাসনে থাকা ইমাম খোমেনি। এর সঙ্গে সঙ্গে ইরানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

 

 

ট্র্যাজেডির মধ্যমণি সাদ্দাম

সাদ্দাম হোসেন। ইরাকের সাবেক রাষ্ট্রপতি। এ পরিচয়ের চেয়ে বড় ছিলÑ তিনি পশ্চিমাদের ত্রাস। বলা হয়ে থাকে, পশ্চিমা বিশ্বের পাতানো ফাঁদে প্রাণপ্রদীপ নিভেছে তার। সাদ্দাম ১৬ জুলাই ১৯৭৯ থেকে ৯ এপ্রিল ২০০৩ পর্যন্ত ইরাকের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ইরাকের রাষ্ট্রপতি ও বাথ পার্টির প্রধান হিসেবে সাদ্দাম হোসেন আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক ইরাক গড়ে তোলার পথে পা বাড়ান। সাদ্দাম একদলীয় শাসন কায়েম করেন, যা ভালোভাবে নেয়নি সভ্যরাষ্ট্রগুলো। সাদ্দাম ইরানের সঙ্গে ৯ বছরের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এরপর ১৯৯১ সালে সাদ্দাম উপসাগরীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সাদ্দাম ইরাকের স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধের সব পক্ষকে নির্মূল করার উদ্যোগ নেন। ইরাকি শিয়া মুসলমান, কুর্দি ও ইরাকি তুর্কি জনগণ এর বিরোধিতা করে স্বাধীনতা দাবি করে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে। সাদ্দাম ব্যাপক ধ্বংসাত্মক জীবাণু অস্ত্র  তৈরি করছেন এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে আগ্রাসন ঘটায়। কিন্তু তাদের এই অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন ছিল। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এমন কোনো অস্ত্রের সন্ধান পায়নি।

সর্বশেষ খবর