রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

পদ্মা সেতু : উন্নয়ন কৌশলের স্মারক

ড. আতিউর রহমান

পদ্মা সেতু : উন্নয়ন কৌশলের স্মারক

নানা প্রতিকূলতা পায়ে দলে স্বদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের বীজ আমাদের জাতির পিতাই বুনে দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা করার স্বপ্নে তিনি জাতিকে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  ভিন্ন দেশ থেকে ধার করে নয়, নিজেদের বাস্তবতায় নিজেদের মতো করে স্ব-উন্নয়নের এক পরিকল্পিত সার্বিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কার্যত জনগণের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা সামাজিক পুঁজি ছাড়া তার হাতে আর কিছুই ছিল না। রিজার্ভ শূন্য। জিডিপি মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার। সঞ্চয় জিডিপির চার শতাংশ। বিনিয়োগ ৯ শতাংশ। তবুও তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামোগুলো পুনর্নির্মাণ করার কাজে লেগে পড়েন। কৃষি ও শিল্পকে সমান গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে গড়তে শুরু করেন তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ। কিন্তু খাদ্য সাহায্যকে ঘিরে উন্নত বিশ্বের মোড়লের মনোভাবে তিনি বিরক্ত। ১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট কারগিল বঙ্গবন্ধুকে চাপ দেন পাকিস্তান আমলের বৈদেশিক দায়দেনা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। অথচ তাদের দেওয়া বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় পুরোটাই বিনিয়োগ করা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য। তাই তিনি এই দায় বৈদেশিক ঋণদাতাদের কথামতো মেনে নিতে অপারগতা জানান। তখন কারগিল ইঙ্গিত করেন যে, এর ফলে খাদ্য সাহায্য পেতে অসুবিধা হতে পারে। তখন তাঁর জনগণ কী খাবেন? এর জবাবে গণভবনের বিস্তর সবুজ মাঠের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- প্রয়োজনে তাঁর জনগণ ওই ঘাস খাবে। তবু কারও কাছে মাথা নোয়াবে না।  বঙ্গবন্ধুর এই অনড় মনোভাব দেখে উন্নয়ন অংশীদাররা পিছু হটে। দায়দেনার প্রশ্নে তিনি যেমন চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত তেমনটিই তারা মেনে নেয়।

আত্মসম্মান সুরক্ষার এই মনোভাব বঙ্গবন্ধুকন্যার মাঝেও আমরা দেখতে পাই। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ১.৪ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সাহায্য দেওয়ার যে আয়োজন বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে উন্নয়ন অংশীদাররা করেছিলেন তা অযথাই এক নোংরা বিতর্কের মাঝে পড়ে যায়। তখনো কোনো আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নির্দিষ্ট করা হয়নি। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কারিগরি কমিটি শর্টলিস্ট করা ঠিকাদারদের প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। কোথাও কোনো কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়নি। এমন সময় বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগের পক্ষ থেকে অন্যায়ভাবে অভিযোগ করা হলো, এ প্রকল্পে দুর্নীতি করা হচ্ছে। এ জন্য তৎকালীন সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের কম হয়রানি করা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের এই বাড়াবাড়ির জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, এ প্রকল্পের অর্থায়ন স্বদেশের অর্থেই করা হবে। পরবর্তী সময়ে কানাডার আদালত রায় দেন, এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এমন করে বাংলাদেশ ও তার নেতৃত্বকে অপমানের বদলা নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতুটি নির্মাণ করে দেশবাসী দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে অফুরন্ত প্রাণের স্ফুরণ ঘটতে দেখতে পাচ্ছি। সেতুর দুই পাড়ের মানুষের মনে আজ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে। ফেরিঘাটে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন এবং শত শত লঞ্চ-স্পিডবোটে যাত্রী পারাপার করতেন যারা তাদের মনেও আনন্দ ধরে না। তারা হয়তো অন্য ঘাটে চলে যাবেন। কিন্তু দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষের চলাচলের সুবিধা এবং সারা দেশের মানুষের আনন্দ দেখে তারাও আবেগতাড়িত।

সারা দেশের অর্থনীতিতে এই সেতুর যে বিরাট প্রভাব পড়তে যাচ্ছে তা খালি চোখেও দেখা যায়। জমির দাম বেড়ে গেছে। কলকারখানা চালুর কাজ শুরু হয়েছে। এমন কি শরীয়তপুরের চরাঞ্চলেও নগরায়ণের হাতছানি মানুষের মনে দোলা দিচ্ছে। ঢাকায় কষ্ট করে জীবনচলার সংগ্রাম ছেড়ে অনেকেই নিজ এলাকায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। তাই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে দক্ষিণ বাংলা তথা বাংলাদেশে আজ প্রাণের মেলা বসেছে। ‘আমরাও পারি’ এই স্লোগানটি আজ সারা দেশেই উচ্চারিত হচ্ছে।

অথচ এই সেতু নির্মাণকে ঘিরে কী দুঃখজনক পরিস্থিতিই না সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়টায় একদল তথাকথিত আলোকিত মানুষ বলতে শুরু করে দিয়েছিল বিদেশি অর্থ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। সে সময়টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের অর্থেই গড়বেন এই সেতু। বাংলাদেশের প্রবাসী আয় তখন বাড়ছিল। রপ্তানিও বাড়ন্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়মিত বাড়ছিল। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকিং খাত এই প্রাণের প্রকল্পের জন্য বিদেশি মুদ্রার সমর্থন দিতে ছিল প্রস্তুত। এমনি এক বাস্তবতায় বিশ্বব্যাংককে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা এই কালজয়ী সিদ্ধান্তটি নেন। আর সেই বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের ফসল আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক এই পদ্মা সেতু। এই সেতু আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে আরেক নাম।

বলতে দ্বিধা নেই যে, এত বড় প্রকল্পের অর্থায়ন বাংলাদেশ নিজেদের সম্পদ থেকেই সম্পন্ন করতে পারে সেটিই ছিল এই পদ্মা সেতু বিতর্কের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সে সময়ে প্রবাসী বাঙালিদের যে দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখেছি তা সত্যি মনে রাখার মতো। তাদের কাছ থেকে কত যে ই-মেইল এবং খুদেবার্তা পেয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কোন ব্যাংকের কোন হিসাবে তারা ডলার পাঠাবেন সেরকম প্রশ্নবাণে আমি জর্জরিত হয়েছি। আমাদের রোদে পোড়া পরিশ্রমী প্রবাসী কর্মীদের দেশের জন্য কিছু করার এই আকুতি সত্যি অসাধারণ। তাদের প্রতি রইল অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের প্রবাসী ভাইবোনেরাও নিশ্চয়ই পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অনুষ্ঠান দেখে উদ্বেলিত হবেন। আমি নিশ্চিত যুগে যুগে বাঙালির কাছে ইতিহাসের এই মুহূর্তটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আবেগ ও উচ্ছ্বাস বাদেও পদ্মা সেতুর প্রভাবে বাংলাদেশের, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে সে বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই। এ অঞ্চলের ২১টি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এই সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেল- দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আর ঝড়-বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না। সেতুটির কারণেই এই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে আসবে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এই অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। বরিশাল শহরের আশপাশের জমির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। পদ্মা সেতুর দুই পারেই এক্সপ্রেসওয়ের পাশের জমির দাম তিন-চার গুণ বেড়ে গেছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়েছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুতগতিতে। আগামীতে বিকাশের এই ধারা আরও বেগবান হবে।

ঢাকার কাছে বলে পদ্মার ওপারে ছোট-বড় নানা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দক্ষিণ বাংলা হবে পর্যটনের এক উৎকৃষ্ট হাব। ছুটি পেলেই ঢাকা ও অন্যান্য নগরের বাসিন্দারা ছুটবেন দক্ষিণ বাংলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের সন্ধানে। তারা যাবেন কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরিদর্শনে, যাবেন পায়রা বন্দরে। পদ্মার চরগুলোতে গড়ে উঠবে নতুন নতুন রিসোর্ট ও পরিকল্পিত ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র। সরকারও এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে পদ্মা পাড়ের পুরো এলাকাকে উন্নত করার লক্ষ্যে। শোনা যাচ্ছে, পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকার। পদ্মা সেতুর কাছেই ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে উঠছে। এখানে থাকবে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব সুযোগ-সুবিধা। পদ্মা সেতুর আশপাশে গার্মেন্ট ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে শিপ-বিল্ডিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মোংলা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মোংলা ইপিজেড, পায়রা বন্দর, রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা গেলে এসব প্রকল্পে বিপুল কর্মসংস্থান ঘটবে। একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। আরও সহজ করে বলা যায় আগামী পাঁচ বছরে ১০ লাখ অর্থাৎ বছরে ২ লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। ১০ বছর পর এই সংখ্যা তিনগুণ হয়ে যাবে।

সার্বিকভাবে এই সেতু আমাদের জাতীয় জিডিপিতে ১.২৬ শতাংশ প্রতি বছর যোগ করবে। আঞ্চলিক জিডিপিতে যোগ হবে ৩.৫ শতাংশ। রেল চালু হলে জাতীয় জিডিপিতে যোগ হবে আরও ১ শতাংশ। প্রতি বছর দক্ষিণ বাংলায় দারিদ্র্য কমবে ১.০৪ শতাংশের মতো। জাতীয় পর্যায়ে তা কমবে ০.৮৪ শতাংশ। উত্তরবঙ্গে যেমন বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে মঙ্গা আর এখন দৃশ্যমান নয়, তেমনি পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার অতিদারিদ্র্যের হারও কমবে। সেখানকার ছিন্নমূল মানুষকে তখন আর ঢাকা বা অন্য নগর পানে কষ্টের জীবন বেছে নিতে হবে না। নিজের পরিবেশেই নিজের জীবন  সংগ্রামে স্বস্তি খুঁজে পাবে বিপর্যস্ত এই দুঃখী মানুষরা।

নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথনকশায় এক নতুন আশা-সঞ্চারি মাইলফলক। তাই আমাদের স্বপ্নের মিনার এই স্থাপনাকে নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস যেন কেবল উদ্বোধনের দিনেই (অর্থাৎ ২৫ জুনই) সীমাবদ্ধ না থাকে।  সরকারের দিক থেকে তো উদযাপন থাকবেই। বৃহত্তর জনসাধারণও যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উদযাপনে অংশীদার হতে পারেন তা নিশ্চিত করা গেলে ভালো হয়।  আমাদের আত্মশক্তির এই উদযাপনকে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ রেখা দিয়ে খন্ড-বিখন্ড করা যাবে না।  পদ্মা সেতু এদেশের সব মানুষের গর্বের ধন।  এই সেতুকে ঘিরে উদযাপনও তাই হওয়া চাই সর্বজনীন।

 

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

সর্বশেষ খবর