শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

কয়েক রকম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ইমদাদুল হক মিলন

কয়েক রকম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শীত সকালের এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে বারান্দায়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়। আমি একটা জলচৌকি নিয়ে বসেছি বারান্দায়। কুয়াশা কেটে গেছে। রোদে মায়াময় হয়েছে চারদিক। নাশতা করিনি, সে কথা মনেও নেই। গত সন্ধ্যা থেকে আছি এক ঘোরের মধ্যে। ঘোরের নাম ‘উজান’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস। এই উপন্যাস স্মৃতিজাগানিয়া। শৈশব কৈশোরে ফিরে যাওয়া। আশ্চর্য এক মায়াবী হাতে লেখা। ভাষার জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা। উপন্যাসের ‘নশঙ্কর’ গ্রামটি আমি চিনি। নশঙ্কর, স্বর্ণগ্রাম, কামারখাড়া বাইনখাড়া বেসনাল এসব গ্রাম হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ি থানায়। মুন্সীগঞ্জ থেকে দক্ষিণে যেতে হয়। সরু নদীটির নাম ‘রজতরেখা’। দিঘির পাড় হয়ে পদ্মায় পড়েছে। পরে জেনেছি ‘বাইনখাড়া’ হচ্ছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গ্রাম। ওই গ্রামের মুখার্জিবাড়ি তাঁদের বাড়ি।

বেসনাল গ্রামে আমার এক দাদার বাড়ি। বাবার মামা। কিশোর বয়সে বহুবার গিয়েছি ওদিকটায়। গ্রামগুলো চষে বেড়িয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের কোনো লেখকের লেখায় যখন বিক্রমপুর প্রসঙ্গ পাই তখন মনটা আনন্দে ভরে যায়। কত জ্ঞানী মহাজন, কত মনীষী, কত বড় বড় লেখক, বিজ্ঞানী জন্মেছেন বিক্রমপুরে। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য ওই অঞ্চলের। আমার জন্মের গ্রাম মেদিনীম ল। লৌহজং থানায়। এখনো রোমাঞ্চিত হই বিক্রমপুরের কথা ভেবে। সেই বিক্রমপুরের নশঙ্কর গ্রামের কথা লিখেছেন শীর্ষেন্দু তাঁর উপন্যাসে। চারপাশের গ্রামগুলোর কথা লিখেছেন স্মৃতি হাতড়ে। সঙ্গে আছে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করার জাদু। ঘোর তৈরি করা এক একটি শব্দ। দিন-রাত ভুলে পড়লাম সেই উপন্যাস। তখন পর্যন্ত ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরে যাওয়া হয়নি। যে নদী গভীর মমতায় জড়িয়ে রেখেছে শীর্ষেন্দুর ছেলেবেলা। উপন্যাসে সেই নদীর কথাও আছে। ‘উজান’ পড়ে আমি তারপর ময়মনসিংহে গিয়েছি। ব্রহ্মপুত্রের তীরে ঘুরে বেড়িয়েছি। অনুভব করেছি বাংলা ভাষার এই মহান লেখককে। ছুঁতে চেয়েছি তাঁর ছেলেবেলা।

আমার লেখালেখি শুরু হয়েছিল তিয়াত্তর সালে। সেই সময় পশ্চিবঙ্গের কয়েকজন লেখক কবি আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন। সুনীল, শীর্ষেন্দু, শ্যামল, দেবেশ, মতি নন্দী, সন্দীপন, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, বরেণ, অতীন একদিকে, আরেকদিকে শঙ্খ, শক্তি, সুনীল, শরৎ, তারাপদ, উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার, এই সব কবি নিয়ে চলছিল আমাদের তর্ক বিতর্ক আর হৈ হল্লা। পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখাও আমাদের আকর্ষণ করে। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাটি নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। অগ্রজ কবিদের মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তীব্রভাবে আকর্ষণ করেন। অগ্রজদের মধ্যে গল্প উপন্যাসে মাতিয়ে রাখছেন সমরেশ বসু, বিমল কর আর রমাপদ চৌধুরী। সন্তোষকুমার ঘোষ, ঘোরকিশোর ঘোষও একইভাবে আকর্ষণ করছিলেন।

একাত্তরের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তুমুলভাবে শুরু হয়েছিল সাহিত্যচর্চা। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান আর মহাদেব সাহা কবিতায় মাতাচ্ছেন আমাদের। গল্প উপন্যাসে শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন একের পর এক গল্প লিখে মুগ্ধ করছেন পাঠককে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন একঝাঁক তরুণ কবি লেখক। সাহিত্যের একটা উৎসব যেন চলছে দুই বাংলায়।

সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় অসামান্য সব গল্প লিখছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি বইও বেরুচ্ছে। ‘একালের বাংলা গল্প’ নামে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি বই পেলাম। প্রায় একই সময়ে পেলাম তাঁর ‘নির্বাচিত গল্প’ নামে আরেকটি বই। এই বইয়ের গল্পগুলোর নির্বাচক হচ্ছেন সন্তোষকুমার ঘোষ। নির্বাচিত গল্পের একটা সিরিজই বেরিয়েছিল। সুনীল, শীর্ষেন্দু, শ্যামল আর মতি নন্দীর। প্রতিটি বইয়েরই বাড়তি আকর্ষণ ছিল সন্তোষকুমার ঘোষের ভূমিকা। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ মিশিয়ে এই চার লেখকের গল্পের ভারি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি।

‘উজান’ পড়ার পর শীর্ষেন্দু আমার নেশা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর লেখার ঘোর থেকে বেরুতেই পারি না। হাতে এক আশ্চর্য জাদুর কলম এই লেখকের। আমাকে সম্মোহিত করে রাখছেন। যেখানে তাঁর যত লেখা পাই গোগ্রাসে পড়ি। কোনো কোনো লেখা দুবার তিনবারও পড়া হয়। আশ্চর্য সব গল্প, আশ্চর্য সব উপন্যাস। এমন এক মায়ার জগৎ তৈরি করেন লেখায় সেই মায়া কাটানোই যায় না। ‘সাপ’ গল্পটা পড়ে বুঝতেই পারিনি সাপটা আসলে বেরিয়েছিল কিনা। দ্বিতীয় বার পড়ে বুঝেছিলাম এই গল্পে সাপ বেরুনো না বেরুনো কোনো ঘটনাই না। গল্পের মুনশিয়ানা অন্য জায়গায়। ‘মুনিয়ার চারদিক’ গল্পেও সাপ। মুনিয়াকে যে মুহূর্তে ছোবল দিল সাপটি, মনে হয়েছিল সেই ছোবল যেন আমার বুকে এসে লাগল। আর একটা ছোট উপন্যাসে সাপের খোলসের বর্ণনা ছিল। চেতনা তোলপাড় করা হাওয়ায় যখন তখন ওড়াউড়ি করে খোলসটি। একটু যেন প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা। ‘দৈত্যের বাগানে শিশু’ নামে একটা গল্প পড়লাম। এ এক অদ্ভুত গল্প। ক্রীড়াভূমি, ডুবরী, অবেলায়, ঘরের পথ, স্বপ্নের ভিতরে মৃত্যু, তোমার উদ্দেশে, চিঠি, পটুয়া নিবারণ, সোনার ঘোড়া, নীলুর দুঃখ, উড়োজাহাজ, উত্তরের ব্যালকনি, ঘণ্টাধ্বনি, ইচ্ছে, টাংকিসাফ এসব গল্পের কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। ‘ইচ্ছে’ গল্পটিতে লিখলেন, ‘এই শেষ পাপ তাপ বাবা। কাল থেকে ভালো হয়ে যাবো।’ ‘টাংকিসাফ’-এ লিখলেন ‘সব গাড্ডা সাফ হয় না।’ বক্সিংয়ের মতো ব্যাপারটিকে শিল্পে রূপান্তর করেছিলেন মোহাম্মদ আলী ক্লে। তাঁকে নিয়ে গল্প লিখলেন শীর্ষেন্দু। গল্পের শুরু হলো ‘দে অল মাস্ট ফল ইন দ্য রাউন্ড আই কল’ ক্লের এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। একেক গল্প লেখার ভঙ্গি একেক রকম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। শেষদিকে এসে শুধু সংলাপে গল্প লিখতে শুরু করলেন। কোনো কোনো ছোট উপন্যাসও লিখলেন শুধু সংলাপ ব্যবহার করে। আর কী আকর্ষণ সেই সব সংলাপের। পড়তে শুরু করলে ছাড়া যায় না।

উল্টোরথ, জলসা, প্রসাদ এসব সিনেমা পত্রিকাতে সত্তরের দশকে ছোট ছোট উপন্যাস লিখতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। খুঁজে খুঁজে সেই সব উপন্যাস জোগাড় করি। পড়লাম নয়নশ্যামা, ফেরিঘাট, শূন্যের উদ্যান। ‘শূন্যের উদ্যান’ উপন্যাসে একটি কবিতার ব্যবহার ছিল। কবিতাটির একটি মাত্র লাইন আমার মনে আছে। ‘পার হয়ে যাই এক শূন্যের উদ্যানে’। সেই কত আগে পড়েছি, তাও মনে রয়ে গেছে। ‘রঙিন সাঁকো’ উপন্যাসটির কথাও মনে পড়ে। ওই সময় যে উপন্যাসটি আমাদের কয়েক বন্ধুকে পাগল করে রেখেছিল সেই উপন্যাসের নাম ‘বৃষ্টির ঘ্রাণ’। একেকটি চরিত্রের মুখ দিয়ে গল্প বলানো। একটা পুরোনো গাড়ি পড়ে আছে। কাচে পুরো হয়ে জমেছে ধুলো। সেই ধুলোর ওপর আঙুল বুলিয়ে লিখে রাখা হয়েছে ‘নান্টু, প্রতিশোধ’। ‘ফেরিঘাট’ উপন্যাসটিতে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ভেসপা চালিয়ে যাচ্ছে নায়ক। কী যে সুন্দর বর্ণনা ছিল সেই দৃশ্যের!

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]

সর্বশেষ খবর