বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

একুশ শতকে বাঙালির সংস্কৃতি

সেলিনা হোসেন

একুশ শতকে বাঙালির সংস্কৃতি

শিল্পকর্ম : সমর মজুমদার

সংস্কৃতি মানে জীবনযাপন। জীবনযাপনের ভঙ্গি, জীবনযাপনের ধারা ও মূল্যবোধ। যতদিন জীবন আছে ততদিন তা যাপিত হবেই। যতদিন তা যাপিত হবে, ততদিন তার নিজস্ব ভঙ্গি, নিজস্ব ধারা ও মূল্যবোধ থাকবেই। সুতরাং একুশ শতকে যদি বাঙালি জাতি বেঁচে থাকে, তার সংস্কৃতিও বেঁচে থাকবে। কিন্তু সে সংস্কৃতি আজকের বাঙালির সংস্কৃতির মতো নাও হতে পারে। নাও হতে পারে কেন? ধরেই নেওয়া যায় যে অবশ্যই হবে না। তার কারণ পৃথিবী এত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে যে, ১৯৯৯-এর বাঙালি জীবনের সঙ্গে ২০৯৯-এর বাঙালি জীবনের বড় রকমের মিল থাকা একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা হবে। মিল না থাকলেই ২০৯৯ সালের জীবন ও সংস্কৃতি বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি থাকবে না, এ কথা কেবল তিনিই বলতে পারেন যিনি জীবনের চলমানতায় বিশ্বাসী নন। কিংবা যিনি জীবন এখন যেমন আছে তাকেই চূড়ান্ত মনে করেন। যিনি জীবনের চলমানতায় বিশ্বাস করেন না কিংবা কোনো এক বিশেষ সময়ের জীবনকে চূড়ান্ত মনে করেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে জীবিত কি-না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।

এই যে আমরা বাঙালি জীবন ও বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলি, বাঙালি জীবন ও বাঙালি সংস্কৃতি মানে কি? এখন থেকে দু’শ বছর আগে বাঙালি জীবন ও বাঙালি সংস্কৃতি কেমন ছিল, এখন থেকে একশ বছর আগে তেমন ছিল না। আবার একশ বছর আগে বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি যেমন ছিল এখন তেমন নেই। দু’শ বছর আগের একজন বাঙালি আমাদের আজকের জীবন ও সংস্কৃতি দেখে যদি বলেন এটি বাঙালি জীবন বা বাঙালি সংস্কৃতি নয়, আমরা কি তা মেনে নেব? এক সময় তো এই ভূখণ্ডে ইসলাম ধর্ম ছিল না। ইসলাম ধর্ম এই ভূখণ্ডে আসার পর আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি, এমনকি ভাষা মারাত্মকভাবে পাল্টে গেছে। তার মানে কি আমরা বাঙালিত্ব হারিয়ে ফেলেছি? মোটেও না। কথাটি হচ্ছে জীবন ও সংস্কৃতিতে খুব কম বিষয়ই স্থায়ী হয়ে থাকে। যেটুকু স্থায়ী হয়ে থাকে সেটুকু একইভাবে এবং একই পরিচয়ে স্থায়ী হয়ে থাকে না। সুতরাং এখনকার জীবন ও সংস্কৃতি আগামী শতকের জীবন ও সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। আমাদের জীবনে ও সংস্কৃতিতে সবচাইতে স্থায়ী যে বিষয়টি আছে, সেটি আমার মনে হয়, আমাদের ভাষা। এই ভাষাও পরিবর্তিত হচ্ছে। একশ বছর পরের বাংলা ভাষা এবং এখনকার ভাষা এক হবে না। আবার পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা এবং আমাদের বাংলা ভাষা এক নয়। তবু শত পরিবর্তন সত্ত্বেও ভাষাই বোধ হয় একমাত্র উপাদান, যা বাঙালি হিসেবে আমাদের চিহ্নিত করে।

এই কয়েক বছর আগেও বাঙালি মেয়েরা শাড়ি পরত, বিশেষ করে বিবাহিত মেয়েরা শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাক পরত না, কিন্তু এখন বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে সবাই শাড়ি ছাড়াও সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ট, ট্রাউজার্স-শার্ট পরে। ব্যাপক হারে অন্য পোশাক পরলেও, শাড়ি বাঙালি মেয়েদের অন্যতম আনুষ্ঠানিক পোশাক হিসেবেই বিবেচিত হয়। নতুন পোশাক পরছে বলেই তো বলা যাবে না যে আমাদের মেয়েরা অবাঙালি হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত গ্রামবাংলার একশভাগ মেয়ে শাড়িই পরে।

এখনকার মেয়েরা একাধিক ভাষায় কথা বলে। তাই বলে বলা যাবে না যে তারা বাঙালি নয়। এখনকার মেয়েরা ভিন্ন দেশের ছেলেকেও জীবনসঙ্গী হিসেবে বিয়ে করে। আগে বিয়ের ভালো পাত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল উচ্চ চাকরি কিংবা বিত্ত, এখনকার মেয়েরা জীবনসঙ্গী হিসেবে তেমন ছেলে খোঁজে, যে তাদের সঙ্গী হবে, স্বামী হিসেবে প্রভুত্ব করবে না। প্রকৃত অর্থে সুখে-দুঃখে, ভালো-মন্দে জীবনসঙ্গী হবে। এই যে পরিবর্তন তা জীবনের পক্ষের পরিবর্তন, একে অস্বীকার করা যাবে না। বরং একে চলমান জীবনপ্রবাহে অঙ্গীভূত করে নিলে সেটাই হবে সংস্কৃতির রূপান্তরের বৈশিষ্ট্য। রূপান্তরের ভেতর দিয়েই সংস্কৃতি এগোয়।

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এই সনাতন ধারণাটি এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। এখন গ্রামের মানুষও রুটি খায়। তাই বলে কি আমরা খোট্টা হয়ে গেছি? রূপান্তর আমাদের খাদ্যাভ্যাস বদলে দিয়ে গরিব জনগোষ্ঠীর ভেতর ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এটা নিঃসন্দেহে সংস্কৃতির সমৃদ্ধি, সংস্কৃতির পিছুটান নয়। কারণ যে সময়ে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদ চালু হয়েছিল সেই আর্থ-সামাজিক এবং ভৌগোলিক পরিবেশ এখন নেই। পরিবর্তন মেনে নিয়ে তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জীবনযাপনই সংস্কৃতির ধর্ম।

এটা তো সত্যি একুশ শতক পূর্ববর্তী শতকগুলোরই ধারাবাহিকতা। এই শতকে রাতারাতি সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এমন ভাবার কোনো সংগত কারণ নেই। বিশেষ করে জীবনযাপনের কিংবা মূল্যবোধের কোনো বড় পরিবর্তন তো নয়ই। এর মূল কারণ চিরকালীন স্বকীয়তার প্রতি বাঙালির প্রবল বোধ এবং প্রবল দারিদ্র্য বাঙালির ব্যাপক পরিবর্তনের পক্ষে একটি প্রধান অন্তরায়। বাঙালি খুব সহজেই তৃণমূল পর্যায়ের ধারণা থেকে নিজেদের উঠিয়ে এনে বলতে পারবে না আমরা এগিয়েছি, এই এগোনোটা গোটা দেশের এবং গোটা জাতির সমগ্রতার। এখনো কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় লাঙল জোয়ালই অবলম্বন। প্রযুক্তির ভিত এ ব্যবস্থাকে দ্রুত আধুনিক করতে পারবে এটা ভাবা যায় না। এর জন্য আরও কয় প্রজন্মের অপেক্ষা আমাদের করতে হবে আমরা জানি না। রাজনীতির হতাশা আমাদেরকে তমসাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এখনকার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ক্ষমতাই প্রধান বিষয়, উন্নয়ন যেটুকু করে সেটুকু নিজেদের গায়ের চামড়া রক্ষার জন্য করে। আমার মনে হয় রাজনীতির হতাশা হবে আমাদের জন্য একুশ শতকের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। মৌলবাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এবং অন্য দলগুলোর তাদের মদদ জোগানো দেখে মনে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতা পিছিয়ে দেবে আমাদের উন্নয়নের ধারা। কতকাল যে টিকে থাকবে লাঙল জোয়াল এবং ধান মাড়াইয়ের কায়িক শ্রম, আমরা জানি না— বানভাসি মানুষ আর কতকাল ধরে বেছে নেবে বস্তিজীবন আমরা জানি না— চাঁদাবাজ, সংঘাত, সন্ত্রাস আর কতকাল কেড়ে নেবে মানুষের স্বস্তি আমরা জানি না— ধর্ষণ, নির্যাতন, পরিত্যক্ত স্বামীর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে কতকাল মেয়েরা আমরা জানি না। একুশ শতকে সামগ্রিক উন্নয়নের ভেতর দিয়ে জনজীবনের জীবনমান দারিদ্র্যমুক্ত হবে এবং সংস্কৃতিতে আনবে বড় জোয়ার এটা স্বপ্নেও আনতে পারছি না।

একুশ শতক কি দেবে শিশুদের? গাড়ির কালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ফুসফুস, যক্ষ্মা? বিষাক্ত আর্সেনিক আক্রান্ত শিশুদের করতল? ভাবতেও ভয় হয়। আগেই বলেছি সংস্কৃতি মানে জীবনযাপন। শিশু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শিশুদের জন্য পরিশীলিত স্নিগ্ধ, পরিবেশ তৈরি করতে না পারা সংস্কৃতির ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতে না পারলে জাতি তার নান্দনিক বোধ হারায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজ ও পীড়িত হয় মনন এবং সংস্কৃতি হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমাদের শিশুদের সামনে সুদিন— এমন ভাবতে পারছি না। শতক আসবে আর যাবে, যদি তার গুণগত পরিবর্তন না হয় তাহলে এই আসা-যাওয়া অর্থহীন, সেটা নিয়ে উৎসবই হতে পারে, বড় অর্জন নয়।

এতকিছুর মাঝেও দুটো পরিবর্তন আমার চোখের সামনে স্পষ্ট। এক. মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে পুঁজির আড়ালে সংস্কৃতির আগ্রাসন। দুই. বিশ্বায়নের ধারণায় সংস্কৃতির গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবনে নানা অনুষঙ্গের প্রবেশ।

পুঁজির আড়ালে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে আমি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক মনে করি। কারণ প্রতিদিনের ব্যবহার্য দ্রব্যের মধ্য দিয়ে বাজার দখলের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। কারণ একদিকে যেমন জাতি অর্থনৈতিকভাবে মেরুদণ্ডহীন হয়, অন্যদিকে তাদের দেশপ্রেম খুব ধীরগতিতে আচ্ছন্ন হতে থাকে, যেটার ফল সুখময় নাও হতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যারা অন্য দেশের আগ্রাসনের কারণে নিজ মাতৃভাষা পর্যন্ত ভুলে গেছে। মেরুদণ্ডহীন জাতির পক্ষে এটিই সহজ। কারণ ক্ষুধা বিলুপ্ত করে সাংস্কৃতিক চৈতন্য আর সাংস্কৃতিক চৈতন্যহীনতা বিলুপ্ত করে অস্তিত্বের শেকড়। একটি জাতির জন্য এ এক চরম নিষ্ঠুরতা।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো বিশ্বায়ন। ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বলে একটি সাধারণ ধারণা চালু হয়েছে। ধারণাটি ঠিক থাকবে, যতক্ষণ প্রতিটি দেশ নিজের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে টিকিয়ে রাখতে পারবে। রূপান্তর আসবে, কিন্তু সে রূপান্তরের ভেতর স্বকীয়তাটুকু বিনষ্ট হবে না। সেটাকে উজ্জ্বল রাখতে হবে। ধরা যাক, আমাদের লোকসংগীতের কথা। আমার গভীর বিশ্বাস, এটি আমাদের সবচাইতে শক্তিশালী সংগীতমাধ্যম। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য থেকে উঠে আসে। লোকসংগীতকে ধারণ করে পপসংগীত তৈরি হচ্ছে। কেন? কারণ নিজেদের শেকড় আঁকড়ে ধরেই শক্তিশালী হতে চায় আরেকটি মাধ্যম। এটিই নিয়ম। শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খুব কঠিন এবং আঁকড়ে থাকাটা কঠিন। এ কঠিন কাজ যে সংস্কৃতি সম্পন্ন করে, সে তার প্রাণ দিয়েই করে। বাঙালির প্রাণটুকুই এখানে। শুধু সংগীত নয়, নাটকও আমাদের এখন অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধ।

শুরুতেই বলেছিলাম একুশ শতকে পরিবর্তন আসবে। আসাটাই স্বাভাবিক। স্থবিরতা যে সময় আঁকড়ে ধরে সে সময় মৃত হয়ে যায়। আমাদের জীবনে তেমন দিন আসুক তা আমরা চাই না। আমরা শস্য এবং আগাছার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাব, তুলে নেব মূলটুকু, ফেলে দেব অসার বস্তু। একুশ শতকের বাঙালির সংস্কৃতির রূপ হবে রূপান্তরের কিন্তু তার বাঙালিত্ব থাকবে তৃণমূলে, থাকবে শহুরে জীবনে।

এ কথাটা কয়েক শতাব্দী ধরে প্রবাহিত পরীক্ষিত সত্য। অলীক স্বপ্ন আমি দেখি না। একুশ শতক নিয়ে প্রবল আশাবাদী হওয়ারও কোনো কারণ নেই। তবে এটুকু নিঃসন্দেহের বলব— শত টানাপড়েনের ভেতরে আমরা ছিলাম, আছি এবং থাকব। থাকব আমাদের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে। থাকব সংস্কৃতির গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে।

আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তন আসবে, কিন্তু একটি স্বাধীন জাতির সামগ্রিক সত্তায় বাঙালি থাকার অনুপ্রেরণা কখনোই নিঃশেষিত হবে না। আমরা তেমন জাতি হব না, যার ভাষা বিনষ্ট হবে, যার হৃদয় থেকে বাঙালির বৈশিষ্ট্যটুকু মুছে যাবে। বাঙালির উৎসব থাকবে, গানে-নাটকে, শিল্প-সাহিত্যে চিরজীবী হয়ে থাকবে তার সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র্য। এই দিকনির্দেশনা একুশ শতককে করবে আলোকিত।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর