গত মে মাসে চীনের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষাকে চীন কীভাবে দেখছে তা দেখা। এর আগেও চীনের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। এবার প্রথমে যাই চীনের হুবেই প্রভিন্সের উহানে অবস্থিত হুবেই ভোকেশনাল কলেজ অব বায়োটেকনোলজিতে। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে কৃষি অর্থনীতি, বীজ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা, উদ্যানবিদ্যা ও প্রকৌশল বিজ্ঞান, অ্যাকুয়াকালচার, কৃষি বাণিজ্য, চা-শিল্প, মেডিসিন টেকনোলজি, ইনফরমেশন সিকিউরিটি টেকনোলজি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স টেকনোলজির মতো ৪৩টি বিষয়ে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠানে তৈরি হওয়া হাজার হাজার দক্ষ হাত যুক্ত হচ্ছে চীনের অর্থনীতি বিনির্মাণে। এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকালে আমরা গিয়ে হাজির হলাম হুবেই ভোকেশনাল কলেজ অব বায়োটেকনোলজিতে। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট গং ফুটিং। বিশাল এলাকাজুড়ে ক্যাম্পাস। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম শিক্ষা নিয়ে তাদের নানা কার্যক্রম। প্রথমে গেলাম ফ্লোরিকালচার সেকশনে। এখানে শুধু ফুলের উৎপাদনই শেখানো হয় না, শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় উৎপাদিত ফুলের কীভাবে মূল্য সংযোজন করা সম্ভব। কীভাবে সাজাতে হয় ফুলের তোড়া, কীভাবে পাওয়া যায় ফুলের সর্বোচ্চ মূল্য।
সম্পূর্ণ জৈবনিরাপত্তা অনুসরণ করে আমরা প্রবেশ করলাম অ্যাকুয়াপনিক্স সেকশনে। আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদের কৌশল শিখছিল শিক্ষার্থীরা। শুধু পাঠ্যপুস্তক নির্ভর জ্ঞান অনুশীলন নয়, বরং ব্যবহারিক শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে তারুণ্যকে তৈরি করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ নির্মাণের কারিগর হিসেবে। সেখানে হর্টিকালচার বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াং ইয়াং উইন্দের সঙ্গে কথা হয় আমার। তিনি তাদের পড়াশোনার মান নিয়ে বলছিলেন। বললেন, ‘হর্টিকালচার বিষয়ে আমি এখানে এক বছর ধরে পড়ছি। আরও দুই বছর রয়েছে আমার এখানকার পড়াশোনা। আমি অনেক কিছু শিখছি। হাতে-কলমে শেখার কারণে আমি দক্ষ হয়ে উঠছি প্রতিনিয়তই। সত্যিই শেখা খুব আনন্দের বিষয়। এখানে পড়াশোনার মাধ্যমে আমি আমার জীবনের ভিত তৈরি করছি, আমার বিশ্বাস এই শিক্ষা আমার পরবর্তী জীবনে ভীষণ কাজে আসবে।’
ঘরের কৃষি শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এলাম মাঠের কৃষি দেখতে। মাঠে মাঠে ফুল আর ফসলের সম্মিলন, সবই হয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে। সেটিই তাদের গবেষণা ও প্রদর্শনী প্লট।
গবেষণা ও প্রদর্শনী প্লট থেকে আমরা গেলাম প্রতিষ্ঠানের ই-কমার্স সেকশনে। অনলাইন বিপণন ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানো হয়। সেখানে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের প্রতিটি স্তর সম্পর্কেই শিক্ষার্থীদের সম্যক ধারণা দেওয়া হচ্ছে। কীভাবে অনলাইনে লাইভে পণ্য বিক্রি করতে হয় তা শুধু হাতে-কলমে শেখানোতেই ক্ষান্ত থাকেননি, একেবারে সরাসরি পণ্য বিক্রি করার মাধ্যমে পেশাদারিত্ব তৈরি করা হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের। চীনের অর্থনীতির বড় একটি অংশে রয়েছে চায়ের অবদান। আমরা একটি ক্লাসরুমে দেখলাম শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে তাদের ঐতিহ্যগত চায়ের পরিবেশনা। একেক রকম চায়ের পরিবেশন কৌশল একেক রকমের। পরিবেশন কৌশলের ওপর নির্ভর করে চায়ের স্বাদ ও মান।
৬৬ বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠান চীনের কৃষি ও কৃষি অর্থনীতিতে কতটা ভূমিকা রেখেছে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিলেন প্রেসিডেন্ট গং ফুটিং। তিনি বললেন, ‘হুবেই প্রভিন্সের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম কিন্তু চীনজুড়ে রয়েছে। চীনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেমন এখানে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে, দেশের বাইরের শিক্ষার্থীরাও আসে। আপনি জেনে খুশি হবেন এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৩০টি দেশ থেকে শিক্ষার্থী এবং পেশাজীবীরা এখানে কোর্স করে গেছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে। আবার অনেক শিক্ষার্থী নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কারিকুলাম আপডেট করি। যেন শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সঙ্গে সহজেই তাল মেলাতে পারে।’
সত্যিই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মুখ দেখেই বোঝা যায়, শেখার মাঝে তারা কতটা আনন্দ লাভ করছে। শিক্ষা তাদের চলার পথ কতটা সহজ করে দিচ্ছে তা ভেসে উঠছে তাদের চোখেমুখে। আমরা বুঝতে চেয়েছি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ চীন কীভাবে অগ্রসর হয়েছে, কীভাবে তারা ক্ষুধায় পীড়িত একটি বহুল জনসংখ্যার জাতি থেকে উৎপাদনশীল স্বয়ম্ভর জাতিতে পরিণত হয়েছে। কতটা গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করছে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। এরপর আমরা হোয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে গিয়েছিলাম। সেই গল্প আপনাদের অন্যদিন শোনাব। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘শিক্ষার জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীনে যাও।’ প্রতি বছর আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশ চীন একটি উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এখানেও উচ্চশিক্ষা অর্জনের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র তৈরি হয়ে আছে।
এ বিষয়ে আমরা কথা বলি চীনে অবস্থিত দেশটির সরকার অনুমোদিত বিদেশি শিক্ষার্থীদের সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান মালিশা এডুর চেয়ারম্যান শেখ কুরবান আলীর সঙ্গে। তিনি নিজেও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করে চীনে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬০টি দেশ থেকে চীনে পড়াশোনা করতে আসার জন্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
শেখ কুরবান আলী জানালেন, চীনে কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি অসংখ্য কোর্স রয়েছে। চীনের পড়াশোনার মান খুব ভালো। রয়েছে অসংখ্য স্কলারশিপের সুযোগ। আর প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীনে পড়াশোনা করলে দেশে আসা-যাওয়া করাটাও সহজ। জীবন গড়তে ভালোমানের উচ্চশিক্ষার জন্য চীন হতে পারে দারুণ গন্তব্য।
মালিশা এডুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মারুফ জানালেন, চীনে পড়তে আসার জন্য তারা তথ্যগত সহায়তার পাশাপাশি চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের চুক্তি আছে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের সেখানে ভর্তির ব্যাপারে তারা সহযোগিতা প্রদান করে। তা ছাড়াও চীনা ভাষা শেখার জন্য তাদের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান আছে। চীন যেমন ক্ষুধাপীড়িত বহুল জনসংখ্যার একটি দেশ থেকে শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে উন্নত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, আমাদেরও টেকসই উন্নয়নের জন্য উন্নত করতে হবে শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থাপনা। শুধু স্থাপনা কাঠামো উন্নয়নেই উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ না রেখে সময়োপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। আমাদের সন্তানরা যেন আনন্দ নিয়ে শেখে তাদের আনন্দময় জীবন, তাদের দক্ষ হাতেই রচিত হোক আগামীর টেকসই বাংলাদেশ।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব