শনিবার, ৪ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

হলি আর্টিজান কল্যাণপুর শোলাকিয়া ও ব্লগার খুনে নর্থ সাউথের নাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

হলি আর্টিজান কল্যাণপুর শোলাকিয়া ও ব্লগার খুনে নর্থ সাউথের নাম

জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্র নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আটক হয়েছেন দেড় ডজনেরও বেশি শিক্ষার্থী। একটি হত্যা মামলায় আদালত দুজনকে ফাঁসি ও চারজনকে বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ড দেয়। এ ছয়জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এরা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এ ছাড়া হিযবুত তাহ্রীর-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এক ডজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, জঙ্গি হামলার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পাঁচ শিক্ষক গ্রেফতার হন। পুলিশি তদন্তের ধরা পড়ে যে, দুনিয়া কাঁপানো হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনাও হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি গিয়াসউদ্দিন আহসানের বাসভবনেই।

এমনকি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর পুত্র চাকরি করতেন এ নর্থ সাউথেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পৃক্ততা নিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। জানা গেছে, শুধু ঢাকা নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নর্থ সাউথ নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে। মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের জঙ্গিসম্পৃক্ততার অভিযোগে যারা আটক হলেন তাদের অধিকাংশই ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এর মধ্যে অনেকের ফেসবুক স্ট্যাটাস পরীক্ষা করে দেখা গেছে ধর্মীয় উসকানি সৃষ্টি করার মতো নানা বক্তব্য। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও তাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১০ মার্চ ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন নর্থ সাউথের পাঁচ শিক্ষার্থী। তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই রেজানুল আজাদ রানা ও সাদমানের নির্দেশনায় তারা রাজীব হায়দারকে হত্যা করেন। এ রানার নির্দেশেই খুন করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়, একই বছর ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস, ৭ আগস্ট গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি নিলয়, ৩১ আগস্ট শাহবাগে ব্লগার ফয়সাল আরেফীন দীপেনকে। ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ কলাবাগানে বাসায় ঢুকে জুলহাজ মান্নান ও তন্ময়কে হত্যা করা হয়। ৬ এপ্রিল ব্লগার নাজিমকে হত্যা করা হয়। সব হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পরিকল্পনাকারী হিসেবে বেরিয়ে আসে রানার নাম। ব্লগার হত্যা মামলার আট আসামির মধ্যে সাতজনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এর মধ্যে রেজানুল হক রানাকে গ্রেফতার করা হয় ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত রানা খুন করেই মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। সেখান থেকে তাকে আটক করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। রানা ছাড়াও নর্থ সাউথের আরও ১১ জনকে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় জড়িত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ছিলেন নর্থ সাউথের ছাত্র। শোলাকিয়ায় হামলাকারী আবির ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে তিনি নিহত হন। এর আগে তিনি হত্যা করেন পুলিশসহ তিনজনকে। গুলশান ঘটনার পরপর বাংলাদেশে আরও জঙ্গি হামলার হুমকি দিয়ে একটি ভিডিওবার্তা প্রকাশ করে তিন তরুণ। যার মধ্যে সস্ত্রীক তুরস্কে পাড়ি জমানো তাহমিদও ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২০১৪ সালে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামে যে ছেলেটি নিউইয়র্কে বোমা হামলা করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, সেও ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। গুলশান হামলার মধ্য দিয়ে আবারও সামনে আসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এ ঘটনায় জড়িত অন্যতম জঙ্গি নিবরাস ইসলাম ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়া বর্তমানে জামিনে থাকা অন্যতম সন্দেহভাজন প্রকৌশলী হাসনাত করিমও নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষক। যাকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে ২০১২ সালে অন্য তিন শিক্ষকের সঙ্গে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালে নয় জঙ্গি নিহত হন। এর মধ্যে তিনজনই নর্থ সাউথের। এরা হলেন তাজ উল হক রাসিক, আকিফুজ্জামান খান, সেজাত রউফ অর্ক নর্থ। এরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। নর্থ সাউথের এক ডজনেরও বেশি শিক্ষক জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই শিক্ষকদের বাইরে আরও ১০ শিক্ষক ছিলেন, যাদের প্রত্যেকেই পাকিস্তানি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশে এই পাকিস্তানি শিক্ষকদের নর্থ সাউথ থেকে বের করে দেওয়া হয়। ইউজিসির তদন্তকারীরা তাদের কোনো বৈধ কাগজপত্রও খুঁজে পাননি। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির লাইব্রেরি থেকে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীরের জঙ্গিবাদী বইপত্র পায় ইউজিসির একটি তদন্ত দল।

যুদ্ধাপরাধীর সন্তানরাই শিক্ষক : নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর সন্তানরা। জানা গেছে, গোলাম আযমের বড় ছেলে আবদুল্লাহ হিল আমান আযমী নর্থ সাউথের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও অন্য ছেলে সাদমান আযমী ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাদিম তালহা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি ডক্টরেট করতে বিদেশে রয়েছেন। গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় আটক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও হলি আর্টিজান ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন হাসনাত করিমের কাছ থেকে প্রথম এ তথ্য জানতে পায় পুলিশ। পরে বিশ্ববিদ্যালয় ওই শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করে। গোয়েন্দাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিযবুত তাহ্রীরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তারা।

সর্বশেষ খবর