রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের পাশাপাশি আসন সংখ্যা বাড়নো এবং নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
গতকাল রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার ভবনে ‘বাংলাদেশ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে এ দাবি জানানো হয়।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া লেজুরবৃত্তি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, কার্যকর না ভোট চালু; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী যুক্ত করা, নির্বাচন কমিশনারদের বয়স ৪৫ বছর নির্ধারণ করা; নির্বাচন বৈধতার জন্য ভোটের হার নির্ধারণ; বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা নির্ধারণ এবং নির্বাচনকালীন জোট করলেও দলের নিজস্ব প্রতীকে ভোট করা আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করার প্রস্তাব দেন বিশিষ্টজনরা। অন্যদিকে, প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় কমানোর জন্য পোস্টার ছাপানোর খরচ, হলফনামার তথ্য; সংস্কার ও প্রচার এবং আসনভিত্তিক পরিচিত সভা আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি আবদুর রউফ, সুজন নির্বাহী সদস্য তোফায়েল আহমেদ, সুজন সহসম্পাদক জাকির হোসেন, সুজন নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা জেসমিন টুলী, ফেমার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান, সাংবাদিক ও কবি সোহরাব হাসান, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল আলীম, প্রযুক্তিবিদ ফয়েজ আহমদ তৈয়ব। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
সাবেক সিইসি আবদুর রউফ বলেন, স্থানীয় ভোটারদের কাছে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলে অবশ্যই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে দল পরিচালনায় গণতান্ত্রিক কর্মকান্ড অনুসরণে বাধ্যবাধকতা আনতে হবে। তাদের ভিতরে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে, মাঠপর্যায়ে নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারা বহাল রাখা সম্ভব হবে না। নির্বাচনে যতদিন পর্যন্ত নমিনেশন বাণিজ্য বজায় থাকবে ততদিন এ দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বা হতে পারে না। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে ভোটাররা দলকে ভোট দেবে, তাদের মনোনীত প্রার্থীকে নয়। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে তারা সংসদের জন্য তাদের মনোনীত ব্যক্তিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। তিনি বলেন, অনূর্ধ্ব ৫০০ ভোটারের জন্য একটি করে ভোট কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সেটা অবশ্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ওই সব প্রতিষ্ঠানকে দেখভাল করবে। ওটাই হবে গণতন্ত্রের বিকাশ কেন্দ্র। স্থানীয় বিষয়াদি যথা- দেন-দরবার, সালিশ, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, ধর্মীয় কার্যাদি সবকিছু সেখানেই চলবে। ১১ সদস্য বিশিষ্ট ওই ক্লাবে নির্বাহী কমিটিতে যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য নন তারা থাকবেন। ওই নির্বাহী কমিটির সদস্যরাই ভোট পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। স্থানীয় শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। আবদুর রউফ বলেন, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টার ভিতর ভোট গ্রহণ শেষ করতে হবে। দুপুর ১২টার মধ্যে অনলাইনে নির্বাচনের ফল নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ভোট না দেওয়ার জন্য জরিমানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রতি ইউনিয়নে, পৌরসভা ও পৌর করপোরেশনের ওয়ার্ডে একজন সহকারী নির্বাচনি কর্মকর্তা ও তার কার্যালয় থাকবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে দেশে পরিবর্তনের একটি আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনতে পারলে আমরা আগামীতে এক সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাব। তিনি বলেন, একতরফা নির্বাচন কোনো নির্বাচন নয়। কারণ নির্বাচন মানেই বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থেকে বেছে নেওয়া। এ ধরনের নির্বাচন যাতে ভবিষ্যতে না হতে পারে সে জন্য দশম জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে হাই কোর্টে যে রিট দাখিল করা হয়েছিল আমরা সেটির ব্যাপারে রিভিউর আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা এবং ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ কমানোর ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতির কিছু দুর্বলতা থাকলেও এটিই তুলনামূলক ভালো পদ্ধতি। পৃথিবীর ৯৭টি দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সফল গণতন্ত্রে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ থাকে না। তাই জবাবদিহির কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তিনি বলেন, ভোট করে রাজনৈতিক দল, ভোট দেয় জনগণ। তাই নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। তাই যতই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক না কেন, নির্দলীয় সরকার ও নিরপেক্ষ প্রশাসন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সাংবাদিক ও কবি সোহরাব হাসান বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতান্ত্রিক না হয়; আমাদের সব আলোচনা নিষ্ফল। চারটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন পাইনি। এমপিরা যে এলাকায় নির্বাচন করবেন সেই এলাকার বাসিন্দা হতে হবে। এই বিধান করতে হবে। আবু সাঈদ খান বলেন, বর্তমানে ওয়েস্ট মিনিস্টার পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কার্যকারিতা নেই। তাই জনআকাক্সক্ষার ভিত্তিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তনের কথা চিন্তা করতে হবে। নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়লে সেটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মুনিরা খান বলেন, রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের মধ্যে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা যায় না। এ জন্য ভোটার এডুকেশন গুরুত্বপূর্ণ। আগে মানি ও মাসল (অর্থ ও পেশি) দিয়ে নির্বাচন ধ্বংস করা হতো, আর এখন ম্যানিপিউলেশন (প্রভাবিত করা) দিয়ে নির্বাচনকে ধ্বংস করা হয়। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরই নির্বাচন আয়োজন করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারলে ওই জাতি বেশি দূর এগোতে পারে না। জেসমিন টুলী বলেন, জনগণ সভ্য হলে আইনের অত প্রয়োজন পড়ে না। ১৯৯১ সালে এখনকার মতো নির্বাচনি আচরণবিধি ছিল না। কিন্তু সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। সরকার ও প্রশাসন নিরপেক্ষ না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, কতগুলো আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হলে সেটি অগ্রহণযোগ্য হবে তা ঠিক করা দরকার। ড. আবদুল আলীম বলেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তন করা হলে প্রার্থীর গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে, সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে এবং নির্বাচনি খরচ কমবে। ‘না-ভোটে’র বিধান প্রবর্তন করা হলে তা যেন অর্থবহ হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার তথা রাষ্ট্র সংস্কারের পর একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা। তিনি কিছু সাংবিধানিক ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য নির্বাচনি সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনি সংস্কারসহ আইনের অস্পষ্টতা দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিধিবিধান। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রস্তাব হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তনের কথা ভাবা, নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ এবং ওই আসনসমূহে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের ব্যাপারে বিবেচনায় নেওয়া। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আমাদের যতগুলো জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, ততবারই ক্ষমতাসীন দল সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। অপরদিকে যতবার জাতীয় নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বা অস্থায়ী সরকারের অধীনে, ততবারই পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীনরা হেরে গেছে। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।