মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বর্বর ও অসভ্য সমাজকে জাহেলি যুগ বলা হয়। সচেতনতার জন্য কিছু চিহ্ন নিয়ে এখানে আলোকপাত করা হলো—
১. মদপান ও মাদকাসক্তি : জাহেলি যুগে মানুষ মাদকাসক্ত ছিল। সমাজে মদপানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বর্তমান যুগেও অনেক স্থানে মদ বৈধ। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশেও আইন করে মদ আমদানি, বিক্রি বৈধ করা আছে। বার, ক্যাবার, ফাইভ স্টার হোটেলসহ সরকার অনুমোদিত অনেক মদের দোকান আছে।
২. জিনা-ব্যভিচার : জাহেলি যুগে জিনা-ব্যভিচার বেশি ছিল। বর্তমানেও বিশ্বব্যাপী জিনা-ব্যভিচার বেড়ে চলছে। এমনকি ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তির সুযোগ আছে।
৩. সুদি কারবার : জাহেলি যুগে সুদের প্রচলন ছিল। বর্তমানেও বিশ্বব্যাপী লেনদেন হয় সুদে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশেও সুদভিত্তিক ব্যাংক, বীমা, ইনস্যুরেন্স সরকারি আইনে বৈধভাবে চলছে।
৪. উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা : জাহেলি যুগে উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা ছিল। কাবাঘর নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করত। বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী উলঙ্গপনা আধুনিক হয়ে দেখা দিয়েছে। একেবারে উলঙ্গ হয়ে চললে দেখতে কিছুটা বিশ্রী লাগে, তাই উলঙ্গপনা আধুনিকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সি বিচ তথা সমুদ্র উপকূলে উলঙ্গ নারীদের শুয়ে থাকার দৃশ্য দূষণীয় মনে করা হয় না।
মোবাইলের উলঙ্গপনা এখন পকেটে নিয়ে ঘুরতে হয়। পত্রিকা, ম্যাগাজিন অর্ধনগ্ন নারীদের ছবি ছাড়া নেই বললেই চলে। যে নায়িকা যত উলঙ্গ হতে পারে বর্তমানে সে তত হিট নায়িকা।
৫. যুদ্ধ-বিগ্রহ : জাহেলি যুগে সামান্য কারণে যুদ্ধ বাধত। যুদ্ধে অসংখ্য মানুষ নিহত হতো। বর্তমান যুগেও সামান্য কারণে যুদ্ধ বাধে। মিথ্যা অজুহাতে যুদ্ধ বাধে। ইরাকের কাছে মারণাস্ত্র আছে বলে সমৃদ্ধ ইরাককে ধ্বংস করা হলো। কিন্তু মারণাস্ত্র বলতে কিছুই পাওয়া গেল না। ফিলিস্তিনে নিরীহ নারী-শিশুসহ গণহত্যা হচ্ছে।
৬. মারামারি-হানাহানি : জাহেলি যুগে সামান্য স্বার্থে গোত্রে গোত্রে মারামারি ছিল। বর্তমানে বিশ্বের কোথাও শান্তি নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পর হানাহানি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নসাৎ করে ক্ষমতা স্থায়ী করতে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর হামলা-মামলা বর্তমানে স্বাভাবিক বিষয়।
৭. আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা : জাহেলি যুগে মুশরিকরা আল্লাহকে স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেব-দেবীর আরাধনা করত। কোনো দেবী ধন-সম্পদের দায়িত্বশীল ক্ষমতাপ্রাপ্ত, কোনো দেবী বিদ্যার ক্ষমতাপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা হতো। কোনো দেবী বিপদ দূর করার দুর্গতিনাশ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত, এভাবে মনে করা হতো।
বর্তমান যুগেও তাই আছে মুসলমান হয়েও কোনো মাজারের গাছের মধ্যে সুতা বাঁধলে সে গাছের সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা আছে মনে করা। এভাবে মাজারের কাছে কিছু চাওয়া, মাজারের উদ্দেশ্যে পশু জবাই, শিরক-বিদআত সবই আছে।
৮. মানুষের রচিত আইনকানুন : জাহেলি যুগে আল্লাহর দেওয়া আইন ও বিধান অমান্য করে গোত্র শাসকরা তাদের সুবিধামতো মনগড়া নিজেদের আইনে গোত্র শাসন করত। আহলে কিতাব ও তাওরাত-ইনজিলের বিধান সুবিধামতো পরিবর্তন করে বিকৃত করেছিল।
বর্তমান যুগে আল্লাহর দেওয়া আইন ও রাসুলের সুন্নাহ বাদ দিয়ে মনগড়া আইন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়। ইংরেজ প্রণীত আইন অনেকাংশে এখনো আছে। দৃষ্টান্ত দিতে গেলে দেখা যাবে জাহেলি যুগের অনেক কিছু বর্তমানে আছে, বরং বর্তমান যুগে তা আরো বিস্তৃত ও আধুনিক হয়ে বিরাজ করছে।
৯. নিরাপত্তাহীনতা : জাহেলি যুগে যেমন সারা বিশ্বে শান্তি-নিরাপত্তা ছিল না, এখনো সে কারণেই শান্তি-নিরাপত্তা নেই।
১০. জাহেলি যুগে ছিল দুর্বলের প্রতি সবলের আধিপত্য। ধনী-গরিব বৈষম্য। সম্মান ও মর্যাদার মানদণ্ড ছিল অর্থ ও ক্ষমতা। ক্ষমতাবান ও ধনীরাই হতো সমাজের নেতৃত্বদানকারী। দুর্বল ও অসচ্ছলরা ছিল নির্যাতিত ও অবহেলিত। বর্তমান সমাজেও জোর যার মুলুক তার নীতি বিদ্যমান। অযোগ্য ও অপরাধী হলেও অর্থ ও ক্ষমতার কারণে তারাই হয় নেতৃত্বদানকারী। ফলে রক্ষক হয় ভক্ষক।
পরিশেষে আমাদের জানা থাকা দরকার, জাহেলি সমাজে মহানবী (সা.) কী করেছিলেন? নবীর উম্মত হিসেবে আমাদের কী দায়িত্ব? ওহি আসার আগে যুবক বয়সে যুবকদের সংঘটিত করে ‘হিলফুল ফুজুল’ সংগঠন করে এই অবস্থা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। পরে নিরিবিলি হেরা গুহায় বসে চিন্তা শুরু করেন কিভাবে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যায়। এ অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি আসে। পৃথিবীতে শান্তি কিভাবে আসবে তা আল্লাহ বলে দেন। মক্কায় আল্লাহর বিধান পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব না হওয়ায় মদিনায় গিয়ে সংগঠিত হয়ে আল্লাহর আইনে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। পরে খলিফাদের আমলেও সে ধারা অব্যাহত থাকে। মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
আজও যদি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র—সব ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলা হয়, আশা করা যায়, আবার ফিরে আসবে শান্তির ফল্গুধারা।
লেখক : অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা