মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় জনগণ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। হঠাৎ থমকে গেলেও পরীক্ষিত বন্ধু জাপান এগিয়ে আসায় আশার সঞ্চার হয়েছে। কাগজেকলমে অপারেশন শুরু না হলেও ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল ব্যবহার করে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজে ব্যবহারের জন্য ২০০-এর অধিক জাহাজের পণ্য খালাস হয়েছে। মাতারবাড়ী বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গেম চেঞ্জারের ভূমিকা রাখবে। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে ১ হাজার ৩১ একর জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে এই বন্দর। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প এলাকায় সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। ৭ অক্টোবর একনেকের সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, বন্দরটি চীন করবে, না ভারত- এ নিয়ে টানাপড়েন চলছিল। পরে সরকার জাপানের মাধ্যমে এই বন্দর নির্মাণের কৌশল নিয়েছে। জাপানের আইনি কাঠামো আছে। তাদের প্রতিষ্ঠান অন্য দেশে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জাপানের প্রকল্পে দেশীয় ঠিকাদার দুর্নীতি করার প্রমাণ পাওয়া যায় না। একনেকের ওই সভায় মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নের ব্যয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায় উন্নীত করার সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। বন্দরটির গভীরতা ১৮ মিটার হওয়ায় ১ লাখ টন ধারণক্ষমতার মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) সহজেই নোঙর করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাসহ নানা কারণে বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়নি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে নির্মাণ ব্যয় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছে। ২১ অক্টোবর প্রকল্প পরিদর্শন শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, ২০২৯ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে। ২০৩০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে পণ্যবাহী জাহাজ (মাদার ভেসেল) চলাচল শুরু করবে। প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আতাউল হাকিম বলেন, নির্মাণ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। মাতারবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আবু হায়দার বলেন, আমরা চাই যথাসময়ে কাজ শেষ হোক। সুফল পাক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা জানান, বন্দরটি চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
জানা যায়, গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাবে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চলছে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরের মাধ্যমে। এতে জাহাজভাড়া বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যায়। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পণ্য পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে ২৩ দিনেই গন্তব্যে পৌঁছবে। এখন চট্টগ্রাম বন্দরের মূল টার্মিনালগুলোতে ১ থেকে ২ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল করে। জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, মাতারবাড়ীতে ৮ হাজার ২০০ একক কনটেইনার পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করতে পারবে।
প্রথমে মহেশখালীর সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আলোচনা শুরু হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য নির্মাণ করা হয় জেটি। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রথম বৃহদাকারের বাণিজ্যিক জাহাজ ‘এমভি ভেনাস ট্রায়াস’ পণ্য নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আসে। একপর্যায়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞ মহলের মতামত নিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধন্ত নেয়। দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় বিদেশ থেকে এলপিজি বা এলএনজি আনতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে এগুলো দেশে আনা হয়। সেখান থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন মাল আনতে পাঠাতে হয় ১০টি ছোট জাহাজ। প্রতি টনে খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ ডলার। বর্তমানে এলপিজি নিয়ে জাহাজ আসছে সরাসরি। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, এই বন্দরে ৮ হাজার টিইইউএসের জাহাজ ভিড়তে পারবে। বন্দর ঘিরে শিল্পায়নসহ গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। বন্দর ঘিরে যে লজিস্টিকস ও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের অবকাঠামো গড়ে উঠবে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মাতারবাড়ী মহেশখালীতে নগরায়ণ হবে। ওই এলাকা দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে পরিণত করবে। জিডিপিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখবে।