শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে অন্যতম দুর্নীতি হচ্ছে নিয়োগ বাণিজ্য। নিয়োগ পরীক্ষায় ফেলকারীদের নম্বরপত্র ঘষামাজা করে অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন সাবেক এই মহাপরিচালক। যার কারণে ক্ষোভে ফুঁসছেন শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। জানিয়েছেন নিয়োগ বাতিলের দাবি। জানা যায়, নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া মোট ৪২ জনের পরীক্ষার নম্বর পরিবর্তনের প্রমাণ পায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে লিয়াকত আলী লাকী পরিচালিত লোক নাট্যদলের যে সাতজনের নম্বরপত্র ঘষামাজা করা হয়েছে সেটার প্রমাণও তদন্ত কমিটি পেয়েছে।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কালচারাল অফিসার পদে চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস মার্ক ১০০ নম্বরের মধ্যে হাসান মাহমুদ পেয়েছিলেন মাত্র ১৫ নম্বর। মোট ৩২৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে তার মেধাক্রম ছিল ১৯৮তম। কিন্তু নম্বরপত্র ঘষামাজা করে তাকে প্রদান করা হয় ১২৬ নম্বর। অনিয়মের মাধ্যমে মেধাক্রমে দ্বিতীয় স্থান দখল করে চাকরি পান তিনি। শুধু হাসান মাহমুদই নয়, তার মতো শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন পদে লিখিত পরীক্ষায় ফেল করা ৪২ জনের নম্বরপত্র পরিবর্তন করে কৃতকার্য দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫ জন এরই মধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
জানা যায়, নম্বরপত্র পরিবর্তনের পর তাতে পরীক্ষা কমিটির প্রধানের যে সই ছিল সেটিও জাল। সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী নিয়োগের এসব অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। এর মধ্যে তার পরিচালিত লোক নাট্যদলের আটজন সদস্য নিয়োগ পেয়েছেন, যাদের মধ্যে সাতজনই লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান একাডেমির একাধিক কর্মকর্তা। এসব নিয়োগের নেপথ্যে আর্থিক লেনদেনেরও ঘটনাও রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
বিতর্কিত এসব নিয়োগ নিয়ে গত বছর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল। তদন্ত প্রতিবেদনেও এসব নিয়োগে নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। ২০২১ সালের ১৯ জুলাই এ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা পড়ে। কিন্তু পরে সেটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ১৯টি ক্যাটাগরিতে মোট ৫৫ পদের বিপরীতে জনবল নিয়োগের জন্য চারটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিল্পকলা একাডেমি। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বিভিন্ন পদে কয়েক ধাপে আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল জমা দেওয়া হয়েছিল একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর কাছে। পরে মহাপরিচালক নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সে ফলাফল পরিবর্তন করে নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দেন। অকৃতকার্য হওয়া মোট ৪২ জনের পরীক্ষার নম্বর পরিবর্তনের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে লিয়াকত আলী লাকী পরিচালিত লোক নাট্যদলের যে সাতজনের নম্বরপত্র ঘষামাজা করা হয়েছে সেটার প্রমাণও তদন্ত কমিটি পেয়েছে। প্রতিবেদনে তার বিস্তারিত উল্লেখও করা হয়েছিল। এ ছাড়া কণ্ঠশিল্পী পদে রোকসানা আক্তার রূপসা ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ২২, মেধাক্রম ছিল ৭৩। সাবেক মহাপরিচালকের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে ঘষামাজার মাধ্যমে নম্বর পরিবর্তন করে ২২ নম্বর পাওয়া রূপসাকে ৬৬ নম্বর প্রদান করে ৭৩ এর মেধাক্রম থেকে মেধাক্রম ৩-এ উন্নীত করা হয়। একই পদে আবদুল্লাহেল রাফীকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অনিয়মের আশ্রয়ে। লিখিত পরীক্ষায় তিনি পেয়েছিলেন ২৮। তা পরিবর্তন করে ৬৭ করা হয়। সোহানুর রহমান পেয়েছিলেন ৩৭। জালিয়াতি করে তার নম্বর বাড়িয়ে করা হয় ৬২। সুচিত্রা রানী সূত্রধর ১০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছিলেন ১৫। তার নম্বর পরিবর্তন করে দেওয়া হয় ৬৪। গাইড লেকচারার পদে মাহবুবুর রহমান লিখিত পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছিলেন ৭৫। পরে নম্বর পরিবর্তন করে তাকে দেওয়া হয় ১০০। নৃত্যশিল্পী রুহী আফসানার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৩৪। তার নম্বর অবশ্য পরিবর্তন না করে নারী কোটায় তাকে নিয়োগ দেখানো হয়। ক্যামেরাম্যান পদে রুবেল মিয়া ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ১২। এটি পরিবর্তন করে তাকে দেওয়া হয় ৮৫ নম্বর। এই নিয়োগের বাছাই কমিটির একাধিক কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন শিল্পকলার সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। পছন্দের প্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষায় পাস না করায় তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানায় নিয়োগ বঞ্চিত যোগ্যরা।
শিল্পকলা সূত্রে আরও জানা গেছে, ৫৫ পদের বিপরীতে সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, সাবেক মহাপরিচালকের পছন্দের প্রার্থীরা বাকি ৯ পদে দায়িত্বরত ছিলেন বলে ওই ৯ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নিয়োগের এসব অনিয়মের বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার কল দেওয়া হলেও কল রিসিভ করেননি শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ।
দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরতরা। এর মধ্যে সাবেক মহাপরিচালকের অনুগত কর্মকর্তাদের কক্ষে তালাও ঝুলিয়েছেন একাডেমির ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।