শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাহাড়ের উৎসব বৈসাবি

ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি

পাহাড়ের উৎসব বৈসাবি

বৈসাবির হাওয়া বইছে পাহাড়ে। চারদিকে সাজ সাজ রব। পাহাড়জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দের বন্যা। বাতাসে ভাসছে বাঁশির সুর আর নূপুরের ছন্দ। বৈসাবি এলেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা মেতে ওঠে আপন উৎসবে। বৈসাবিকে ঘিরে প্রায় অর্ধমাসব্যাপী চলে তাদের নানা আয়োজন। বসানো হয় হরেক রকম মেলা। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বসবাসরত ১০ ভাষাভাষী ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও পণ্য প্রদর্শনী এ মেলার প্রধান আকর্ষণ। এ উৎসবে শুধু ক্ষুদ্র্র নৃ-গোষ্ঠীরা নয়, মেতে ওঠে বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষ। পাহাড়ে অন্যরকম বৈসাবি উৎসব দেখতে ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক। সব মিলে বৈসাবিকে ঘিরে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে এ পাহাড়ি জনপদ।

 

বৈসাবি

বাংলাদেশে শুধু পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা ভিন্নভাবে পালন করে বর্ষবরণ উৎসব। নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা-সাংগ্রাই ও চাকমারা-বিজু নামে পালন করে এ উৎসবকে। তাদের বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে উৎপত্তি হয়েছে ‘বৈসাবি’ নামের। এ বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা। সাধারণত বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও পার্বত্য জেলায়।

 

পার্বত্যাঞ্চলে-চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের বৈসাবি উৎসব

চৈত্র মাস এলেই একটি পাখি এসে বিজু বলে ডাক দিয়ে যায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা এ পাখিকে বিজু পেক্কো (বিজু পাখি) বলে। তাদের ধারণা এ পাখির সুমধুর কলতান বৈসাবি উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। শুরু হয়ে যায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বৈসাবির প্রস্তুতি। পার্বত্যাঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে পালন করে থাকে এ বৈসাবি উৎসব।

 

ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু

ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। বৈসু উৎসব এদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। তারা এ বৈসু উৎসব একটানা তিন দিনব্যাপী পালন করে। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলোর নাম হলো- হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু। বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। এ দিন  ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা ঘরদোর লেপেপোছে, বসতবাড়ি কাপড়-চোপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। ত্রিপুরারা বিশেষ এক প্রকার গাছের পাতা আর হলুদের রস মিশিয়ে গোসল করে। ফুল আর নিমপাতা দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। গবাদিপশুদের  গোসল করানো হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়। শিশুরা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে। তরুণ-তরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামিং পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুষ্পপূজা করে। এদিন মহিলারা বিভিন্ন চালের পিঠা ও চোলাই মদ  (দৌ-চুয়ানি)   তৈরি করে। পুরুষেরা বাঁশ ও বেত শিল্পের প্রতিযোগিতা ও  খেলাধুলায় মেতে ওঠে। এদিন এরা দাং, গুদু, চুর, সুকুই, উদেং ও ওয়াকারাই খেলায় অংশগ্রহণ করে। জুম কৃষক পাড়ার মধ্যে হাঁসমুরগির জন্য শস্যদানা ছিটিয়ে দেয়। হারি  বৈসু উৎসবের দিন থেকে এরা গরয়া নৃত্য পরিবেশন শুরু করে। এ নৃত্য সাত দিন থেকে আটাশ দিন পর্যন্ত চলে।  ঢোলের তালে তালে সারিবদ্ধভাবে লোকজন নাচে। নাচ শেষে গরয়া পূজার ব্যবস্থা করা হয়।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিসুমাতে ত্রিপুরারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়, ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। সবাই গ্রামে গ্রামে ঘুর বেড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাচন,  সেমাই ও মিষ্টি খায় এবং কলাপিঠা, চুয়ানপিঠা, জালপিঠা, উনপিঠা ও মায়ুংপিঠা খায়।

এ ছাড়া এদিন তারা নিরামিষ ভোজন করে। কোনো প্রাণী বধ করে না। অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন বিসিকাতালে আমিষ খাবার গ্রহণে বাধা নেই। এদিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার  নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। কেউ কিছু না খেয়ে ফিরে না যায় সেজন্য সারাদিন ঘরের দরজা খোলা থাকে। এতে গৃহস্থের কল্যাণ হবে বলে মনে করা হয়।

 

মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই

মারমারা পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে সাংগ্রাই উৎসব বলে। তারা বৈশাখের প্রথম দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পাচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা জনগোষ্ঠী। সবাই নতুন পোশাক পরে, একে অপরের বাড়ি যায় এবং কুশলবিনিময় করে। সব বয়সের নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে নাচ আর গানে মেতে ওঠে। মারমারা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যায়। এদিন বুদ্ধ মূর্তিকে চন্দন জলে স্নান করানোর পর বৃদ্ধরাও স্নান করে এবং নতুন পোশাক পরিধান করে। বয়স্করা মন্দিরে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়। মারমা জনগোষ্ঠীর এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে জল অনুষ্ঠান বা পানি খেলা। মারমা ভাষায় জল অনুষ্ঠানকে বলা হয় রিলংপোয়ে। বাড়ির আঙিনায় আগে থেকে পানি খেলার জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা থাকে। মারমা যুবকরা বাদ্য আর গানের তালে তালে এসে উপস্থিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে। সেখানে ফুলে ফুলে সজ্জিত প্যান্ডেলের ভিতরে পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে মারমা তরুণীরা। চলে যুবক-যুবতীদের একে অপরের প্রতি জল ছিটানো। পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমা তরুণ-তরুণীরা পানি ছিটিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়।

 

চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু

চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব হলো বিজু। এরা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে। ফুল বিজুর দিন বন, জঙ্গল থেকে ফুল সংগ্রহ করে চার ভাগে ভাগ করে এক ভাগ ফুল ও নিমপাতায় ঘরবাড়ি সাজায়, দ্বিতীয় ভাগ ফুল  বৌ বিহারে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে প্রার্থনা করে ও ভিক্ষুসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে, তৃতীয় ভাগ ফুল নদী, খাল বা ছড়ার পাড়ে তৈরি পূজামণ্ডপে রেখে প্রার্থনা করে এবং চতুর্থ ভাগ ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়। মূল বিজুর দিনে অসংখ্য কাঁচা তরকারি সংমিশ্রণে পাচন বা ঘণ্ট তৈরি করা হয়। এ ছাড়া পায়েস ও নানা ধরনের পিঠা তৈরি করা হয় এবং মাছ-মাংস রান্না করা হয়। বিন্নি ধানের খই, নাড়ু,  সেমাই ও পাহাড়ি মদও (দৌ-চুয়ানি) থাকে। এই দিনে চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে র‌্যালিতে যোগ  দেয়, আবালবৃদ্ধবনিতা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণীরা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি-ঘর, উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। মন্দিরে গিয়ে  মোমবাতি জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়।

 

গজ্যাপজ্যা

চাকমাদের গজ্যাপজ্যা অনুষ্ঠিত হয় নববর্ষের প্রথম দিনে। এদিন চাকমা সম্প্রদায় বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে বিশ্রাম করে। তারা বড়দের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় সবাই বৌ"বিহারে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়, ভিক্ষু সংঘের ধর্মোপদেশ শুনে এবং বিশেষভাবে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে। এ দিন পাহাড়ি গ্রামগুলোতে গেংগুলিদের দিয়ে পালা গান ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নৃত্যের আয়োজন করা হয়। এভাবে গজ্যাপজ্যা দিনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

 

পার্বত্যাঞ্চলে বাঙালিদের পয়লা বৈশাখ

পয়লা বৈশাখ মানে পাহাড়ি-বাঙালিদের লালপাড় সাদা শাড়ি আর ছেলেদের ধুতি-পাঞ্জাবি। এ দিন পার্বত্যাঞ্চলের বসে পাহাড়ি-বাঙালিদের মিলন মেলা। একাকার হয়ে যায় বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষ। গড়ে ওঠে  জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতির মেলবন্ধন। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। কেউ কারও প্রতি বিশেষভাব পোষণ করে না, সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে না। পুরনো বছরের সব গ্ল্যানি মুছে বছরের  শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন-মোট তিন দিনই মূলত বর্ষবরণ উৎসব ‘বৈসাবি’ অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ পালিত হয় বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়। এদিন থাকে না জাতিগত কোনো বিবেদ। রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে বের করা হয় বর্ণাঢ্য আনন্দ র‌্যালি। পয়লা বৈশাখ সূর্যোদয়ের পর পর স্থানীয় শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর