শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ইসলামের ইতিহাসে আলোচিত কালো মানুষের কাব্য

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইসলামের ইতিহাসে আলোচিত কালো মানুষের কাব্য

ইসলামে সব বর্ণের সমান মর্যাদা

পৃথিবীর বুকে ইসলাম এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ছিল সমগ্র মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। এখানে জাতি, গোত্র কিংবা বর্ণের কোনো বৈষম্য নেই। পবিত্র কোরআনের ৪৯ নং সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘হে মানুষ! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার।’’ একইভাবে ৩০ নং সূরা রুমের ২২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “আর তার (আল্লাহ্র) নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম নিদর্শন, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)ও গোত্র বা বর্ণ নয়, বরং ইমান, আকিদা ও চরিত্রের ওপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি বারংবার পবিত্র কোরআনের ৩ নং সূরা আলে ইমরানের ১০৬ নম্বর আয়াত এবং ৩৯ নং সূরা জুমার ৬০ নম্বর আয়াতের কথা স্মরণ করতেন; যেখানে বলা হয়েছে, পরকালে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং সৎ ব্যক্তির মুখ থাকবে সাদা বা উজ্জ্বল। আর যারা অবিশ্বাস করেছে বা আল্লাহর প্রতি দোষারোপ করেছে, তাদেরই মুখ হবে কালো। বর্ণবাদ ছিল না বলেই ইসলামে সাম্যের বাণী জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ইসলাম ধর্মের ভিত্তি স্থাপন, প্রচার, প্রসার ও সুরক্ষায় অতুলনীয় ভূমিকা রেখেছেন অসংখ্য কালো বর্ণের মানুষ। এদের মধ্যে ইসলামের প্রাথমিক যুগে কয়েকজন কালো সাহাবি বা উম্মতের অবদান ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে পবিত্র ঘর কাবার দেয়াল ও পর্দার কালো রং সব মুসলমানের শ্রদ্ধার পাত্র।

 

হজরত সুমাইয়া (রা.) প্রথম শহীদ

বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শান্তির ধর্ম ইসলাম। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং ইসলাম প্রচারের অভীষ্ট লক্ষ্যে কাজ করেছেন লাখো কোটি মুসলমান। ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ও শহীদের মর্যাদাপ্রাপ্ত মুসলমান নারী-পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। তবে মহানবী (সা.) কর্তৃক নবুয়ত প্রাপ্তির পর ইসলাম ধর্মকে ভালোবেসে যারা ইসলামেরই স্বার্থে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং শহীদ হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন, হজরত সুমাইয়া (রা.) তাঁদের পথপ্রদর্শক। কারণ গোপনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অপরাধে তাঁকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয় এবং সব শেষে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাই তিনিই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ হিসেবে স্বীকৃত। 

হজরত সুমাইয়া (রা.) ছিলেন তৎকালীন মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আবু হুদাইফাহ ছিলেন মক্কার মাখজুম গোত্রভুক্ত। এই মাখজুম গোত্র বংশমর্যাদায় ছিল উচ্চস্থানীয়। হারানো ভাইকে খুঁজতে ইয়েমেন থেকে মক্কায় আসা মাধহিজ বংশোদ্ভূত যুবক হজরত ইয়াসির ইবনে আমির (রা.)-এর ঠাঁই হয় মক্কার নেতা আবু হুদাইফাহ ইবনে আল মুঘগিরাহর বাড়িতে। এই বাড়িতেই দাসী সুমাইয়া (রা.)-এর সঙ্গে ইয়েমেনের যুবক হজরত ইয়াসির ইবনে আমির (রা.)-এর বিবাহের ব্যবস্থা করেন তাদের মনিব আবু হুদাইফাহ। উল্লেখ্য, স্বামী ইয়াসির ইবনে আমির (রহ.)ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে শহীদ হন এবং ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় শহীদ হওয়ার গৌরব লাভ করেন। তাদের পুত্রের নাম ছিল হজরত আম্মার (রা.)। তবে এই পরিবারের আরও দুই সন্তান হজরত হারথ (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ (রা.) হজরত ইয়াসির ইবনে আমির (রহ.)এর সন্তান হলেও হজরত সুমাইয়া (রহ)-এর গর্ভজাত সন্তান কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যে সাতজন ভাগ্যবান মানুষ প্রথম মুসলমান হয়েছিলেন, হজরত সুমাইয়া (রা.) তাদের একজন। এক বর্ণনা মতে, অন্যরা হলেন হজরত আবু বকর (রা.), হজরত বিলাল (রা.), হজরত খাব্বাব (রা.), হজরত সুয়াইব (রা.) এবং হজরত আম্মার (রা.)। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বর্ণনা শুনে হজরত সুমাইয়া (রা.) তাঁর পরিবারসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মূর্তিপূজা বন্ধ করেন। ফলে দীর্ঘদিন মূর্তিপূজায় অভ্যস্ত কুরাইশ ও অন্যান্য মক্কাবাসী তা মেনে নিতে পারেনি। হজরত সুমাইয়া (রা.) কে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে নিজেদের পক্ষে ফেরত নিতে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। দিনের পর দিন স্বামী-সন্তানসহ হজরত সুমাইয়া (রা.)-কে মোটা কাপড় বা জুব্বা পরিয়ে মরুভূমির কড়া রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। একদা পানির মটকায় চুবিয়ে মটকাটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। একদল গবেষকের মতে, হজরত সুমাইয়া (রা.) ছিলেন ক্ষীণকায় কালো মহিলা। কিন্তু শত অত্যাচারের মধ্যেও তিনি ইমানের শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন এবং কোনো অবস্থায় কালেমা ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না।

তৎকালে নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন মখজুম গোত্রের আবু জাহেল। প্রকৃত মনিব আবু হুদাইফাহর মৃত্যুর পর হজরত সুমাইয়া (রা.)-এর ওপর অত্যাচার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এরই মাঝে কুখ্যাত আবু জাহেলের দৃষ্টিগোচর হলে হজরত সুমাইয়া (রা.)-এর জীবনে আরও দুর্ভোগ নেমে আসে। এরই এক পর্যায়ে আবু জাহেল ইসলাম ত্যাগের আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় হজরত সুমাইয়া (রা.)-কে বর্শার আঘাতে হত্যা করে।

আবার কারও মতে ধারালো ছুরির আঘাতে তাকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীকালে বদরের যুুদ্ধে আবু জাহেলের মৃত্যু ঘটলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত সুমাইয়া (রা.)-এর পুত্র আম্মারকে বলেন যে, আল্লাহ তাঁর (আম্মারের) মায়ের হত্যাকারীকে হত্যা করেছেন।

 

আম্মার ইবনে ইয়াসির- বীরযোদ্ধা

আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) মুসলমানদের কাছে বিশেষত শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি ছিলেন তৎকালীন হিজাজের (বর্তমান সৌদি আরব) মাখজুম গোত্রভুক্ত। তার বাবা ইয়াসির (রা.) ছিলেন মূলত ইয়েমেনের বাসিন্দা, যিনি পরবর্তীতে মক্কায় বসতি গড়েন। তিনি মক্কার তৎকালীন নেতা আবু হুদাইফার কালো দাসী হজরত সুমাইয়া (রা.) কে বিবাহ করেন। তাদেরই ঘরে জন্ম নেন হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)। তাই জন্ম সূত্রেই তিনি ছিলেন কৃষ্ণবর্ণের এবং পারিবারিকভাবে আবু হুদাইফার ক্রীতদাস কিন্তু ইসলামের সুমহান বাণী শুনে বিশেষত হজরত আবু বকর (রা.)-এর প্রভাবে এই পরিবার গোপনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে অত্যাচারের মাধ্যমে তাদের ইসলাম ত্যাগের প্রচেষ্টা চালায় তাদের মনিব ও অন্যান্য কুরাইশ। কিন্তু ইমানের বলে বলীয়ান তার বাবা হজরত ইয়াসির (রা.) এবং মা হজরত সুমাইয়া (রা.) অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আবু জাহেলের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। তবুও ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেননি। এ সময় হজরত আম্মার (রা.) অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। এরপর শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। উল্লেখ্য, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের কাছাকাছি সময়ে হজরত আম্মার (রা.) জন্মগ্রহণ করেন এবং তারই মধ্যস্থতায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হয় বলে বর্ণিত আছে।

মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলেও হজরত আম্মার (রা.)-এর প্রতি অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বাড়াতে থাকে আবু জাহেল ও তার দোসররা। এক পর্যায়ে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হজরত আম্মার (রা.) কুরাইশদের দেব-দেবীর প্রশংসা করে জীবন বাঁচান। পরক্ষণেই তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে ছুটে যান এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে সমগ্র ঘটনা বর্ণনা করেন। মহানবী (সা.)-এর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অত্যাচারের কারণে মুখে দেব-দেবীর প্রশংসা করলেও অন্তর থেকে তিনি ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য পোষণ করেন। এমনি এক প্রেক্ষাপটে পবিত্র কোরআনের ১৬তম সূরা আন নাহলের ১০৬তম আয়াত নাজিল হয়, যেখানে যাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও ইমান রয়েছে তারা কারও অত্যাচারে বা চাপে বাহ্যিকভাবে আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসের কথা বললেও শাস্তি পাবে না বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে। আবু জাহেলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হজরত আম্মার (রা.) মহানবী (সা.)-এর পরামর্শক্রমে অন্য মুসলমানদের সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন। পরে মহানবী (সা.) এর মদিনায় হিজরতের সময়ও তার সঙ্গী হন। মহানবী (সা.) এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সামনে থেকে ইসলাম রক্ষার জেহাদে নেতৃত্ব দেন হজরত আম্মার (রা.)। বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে মুসলমান সৈন্যদের একটি অংশের নেতৃত্ব দেন তিনি। কখনো ঝাণ্ডা হাতে শত্রুর মনে ত্রাসের সঞ্চার করেন। তবে জীবদ্দশায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত আম্মার (রা.)-এর পরকালে সম্মান এবং ইহকালে শত্রুর হাতে মৃত্যুর ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন বলে বর্ণিত আছে। বাস্তবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলামের ইতিহাসে যে বিভক্তি শুরু হয়, তার নির্মম শিকার হন হজরত আম্মার (রা.)। হজরত আবু বকর (রা.)-এর সময় যে ‘রিদ্দা’ বা আন্তঃকোন্দল শুরু হয়, তারও নির্মম শিকার হন হজরত আম্মার (রা.)। হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে তিনি ইরাকের কুফা অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হন। তবে বিভিন্ন কারণে তিনি হজরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং ‘উটের যুদ্ধ’ এবং ‘সিফফিনের যুদ্ধে’ হজরত আলী (রা.)-এর মূল সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সিফফিনের যুদ্ধের সময় সিরিয়ায় শহীদ হন হজরত আম্মার (রা.)। সিরিয়ার রাক্কা শহরে তাকে সমাহিত করা হয় এবং তার কবরে একটি সৌধ বা মাজার নির্মিত হয়। সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধের শুরুতে অর্থাৎ ২০১০ সালের ১২ মার্চ আল-কায়েদার রোমার আঘাতে এই মাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

 

লোকমান হাকিম- যাঁর নামে ৩১ নম্বর সূরা

পবিত্র কোরআন শরিফের ৩১ নম্বর সূরার নাম সূরা লোকমান। পবিত্র কোরআনে একজন নারী (হজরত মারিয়াম আ.) এবং কয়েকজন পুরুষের নামে সূরা নাজিল হয়েছে। এসব পুরুষের মধ্যে একমাত্র লোকমান আল হাকিম ছাড়া বাকি সবাই নবী-রসুল নামে স্বীকৃত। তবে লোকমান হাকিমও একজন নবী ছিলেন বলে মনে করেন কেউ কেউ। তবে কোরআন বা হাদিস তা সমর্থন করে না।

ইতিহাসের বর্ণনা মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ অব্দে তৎকালীন নুবিয়া (যা বর্তমানে সুদান নামে পরিচিত) নামক স্থানে লোকমান হাকিমের আবির্ভাব ঘটে। পারস্য, তুরস্ক এবং আরবি সাহিত্যে ও লোকগাথায় লোকমান হাকিমের নামে বহু গল্প ও কিংবদন্তি স্থান পেয়েছে। আরেক দল গবেষক হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের বহু আগে অতিমানবীয় গুণসম্পন্ন এক ব্যক্তির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন, যার নাম লোকমান। তিনি বর্তমান ইয়েমেনের নিকটবর্তী আল আহকাফ নামক স্থানে বসবাস করতেন। তবে তিনি পবিত্র কেরআনে বর্ণিত লোকমান হাকিম কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

তবে লোকমান হাকিম যে কৃষ্ণবর্ণের ক্রীতদাস ছিলেন এ বিষয়ে সব গবেষকই একমত। সেই আমলে পশু-পাখির মতো দরিদ্র ও অনুন্নত দুর্গম এলাকা থেকে ক্রীতদাস শিকার বা বন্দী করা হতো। লোকমান হাকিমকেও একইভাবে বন্দী করা হয় এবং এক মনিবের কাছে বিক্রি করা হয়। এই মনিব লোকমান হাকিমের মধ্যে বিশেষ প্রতিভা, তীক্ষè বুদ্ধি এবং ঐশ্বরিক জ্ঞান লক্ষ্য করেন। কথিত আছে, একদা তাঁর মনিব পরীক্ষাস্বরূপ লোকমান হাকিমকে একটি ভেড়া জবাই করে ভেড়ার নিকৃষ্ট অংশ নিয়ে আসতে বলেন। লোকমান হাকিম ভেড়ার জিহ্বা এবং হৃৎপি- নিয়ে হাজির হন। একই ভাবে অন্যদিন আরেকটি ভেড়া জবাই করে ভেড়ার উৎকৃষ্ট অংশ আনতে বলা হলে লোকমান হাকিম আবারও ভেড়ার জিহ্বা এবং হৃৎপিন্ড  নিয়ে হাজির হন। এর ব্যাখ্যা চাওয়া হলে, বিজ্ঞ লোকমান হাকিম বলেন যে, কোনো ব্যক্তির জিহ্বা ও হৃদয় যদি ভালো হয় তবে সে সৎ ও ন্যায়ের পথে ধাবিত হয়। আবার ওই জিহ্বা এবং হৃদয় যদি মন্দ হয়, তবে পৃথিবীর যাবতীয় মন্দ কাজে সে জড়িয়ে পড়ে। তাই জিহ্বা এবং হৃৎপিন্ড  হলো একাধারে দেহের উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট অংশ। লোকমান হাকিমের এই ব্যাখ্যা তাঁর মনিবকে বিস্মিত করে। তাই তিনি লোকমান হাকিমকে সমীহ করে চলতেন।

লোকমান হাকিমের পরিচয় নিয়ে একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। এক ধরনের বর্ণনায় তাকে লোকমান ইবনে আনকা ইবনে সাদুন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার জেরুজালেমের প্রবীণ ব্যক্তি লোকমান ইবনে থারানই যে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত লোকমান হাকিম  তাও মনে করেন কেউ কেউ। অন্যত্র লোকমান হাকিম হজরত আইয়ুব (আ.)-এর চাচা ‘ধাজার’-এর পুত্র ছিলেন বলে উল্লিখিত। একাধিক গ্রন্থে তাকে হজরত দাউদ (আ.)-এর আমলের বিচারক বলে বর্ণিত হয়েছে। তৎকালে নবী-রসুলগণ তথা মানব সম্প্রদায় অকল্পনীয় মাত্রায় দীর্ঘজীবী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এক বর্ণনায় লোকমান হাকিম এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন বলে উল্লিখিত। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি প্রকৃতি থেকে অনেক কিছু শিখেছেন বলে বিশ্বাস করত আরব সম্প্রদায়। এই ধারণা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ও প্রচলিত ছিল।

তবে লোকমান হাকিমের জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করতে মহান আল্লাহ ৩১ নং সূরা লোকমানের ১২ নং আয়াতে বলেছেন, ‘আমিই লোকমানকে হিকমত দান করেছিলাম এই বলে, (যে) আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ লোকমান হাকিম তার ছেলেদের যেসব উপদেশ দিয়েছেন, তা সূরা লোকমানে উল্লিখিত এবং পবিত্র কোরআনের অংশ।

 

হজরত বিলাল (রা.) প্রথম মুয়াজ্জিন

ইসলামের প্রাথমিক যুগে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেও এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সাহাবির নাম ইজরত বিলাল ইবনে রাবাহ আল হাবাসি (রা.)। তৎকালীন ‘হেজাজ’ অঞ্চলে বর্তমানে সৌদি আরবে ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম হয়। রাজকন্যা হয়েও দাসীতে পরিণত হন তার মা হোমামা। বাবা রাবাহ যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দী হয়ে দাসত্ববরণ করেন। প্রথা মোতাবেক দাস-দাসীর ঘরে জন্ম নিয়ে হজরত বিলাল (রা.)ও দাসে পরিণত হন। বিভিন্ন গ্রন্থমতে, হজরত বিলাল (রা.) ছিলেন কালো, লম্বা, মোটা ঠোঁট, চ্যাপ্টা নাক এবং কোঁকড়ানো চুলবিশিষ্ট। তবে তার কণ্ঠ ছিল ভরাট ও শ্রুতিমধুর।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক দিনগুলো ছিল ভয়ঙ্কর ও ঝুঁকিপূর্ণ। ইসলাম ও মানবতার শত্রু তৎকালীন কুরাইশগণ তখন ইসলাম গ্রহণকারীদের শত্রুরূপে গণ্য করত এবং তাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাত। এমনি এক প্রতিকূল পরিবেশে হজরত বিলাল (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এক আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করে ‘ওয়াহেদ’ (অর্থাৎ এক) উচ্চারণ করতে থাকেন। এতে বহু দেব-দেবীর উপাসক কুরাইশরা বিশেষত হজরত বিলাল (রা.)-এর মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ফলে তারা অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায় হজরত বিলাল (রা.)-এর ওপর। প্রথম দিকে তাকে বেঁধে চাবুক ও লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। পরবর্তীতে তাকে কড়া রোদে উত্তপ্ত বালুর ওপর শোয়ানো হতো এবং বুকের ওপর ভারী পাথর চাপা দেওয়া হতো। গরমে তার চামড়া, গোশত ও চর্বি পুড়ে হাড় বের হয়ে গিয়েছিল। ক্রমাগত অত্যাচারে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। আবার জ্ঞান ফিরলেই তিনি বলতেন ‘ওয়াহেদ’ অর্থাৎ আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। অথচ এই একটি শব্দ (ওয়াহেদ) উচ্চারণ বন্ধ করার বিনিময়ে কুরাইশরা অত্যাচার বন্ধ করা এমনকি মুক্তি প্রদানের নিশ্চয়তাও দেয়। সব শেষে প্রকাশ্যে না বলে মনে মনে উচ্চারণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। কিন্তু সব অত্যাচার সহ্য করেও তিনি কণ্ঠে ধারণ করেন ‘ওয়াহেদ’ আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়, তার এই করুণ অবস্থার কথা জেনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশে হজরত আবু বকর (রা.) একজন শক্ত সামর্থ্যবান ক্রীতদাসের বিনিময়ে হজরত বিলাল (রহ.)-কে মুক্ত করেন, সেই থেকে আমৃত্যু তিনি ইসলামের জন্য খেদমত করেছেন।

হজরত বিলাল (রহ.) ছিলেন সততা ও বিশ্বস্ততার মূর্ত প্রতীক। কাবাঘরের চাবি তার তত্ত্বাবধানে রাখা হয়, যুদ্ধের জন্য ধনসম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব পান এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সব গণিমত বা দখলকৃত ধন-সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব ছিল হজরত বিলাল (রহ.)-এর ওপর। পৃথিবীর বুকে প্রথম আজান ধ্বনিত হয় তারই কণ্ঠে। প্রথমে মদিনার মসজিদ আল নববীতে তিনি আজান দেন। মক্কা বিজয়ের পর কাবাঘরের ছাদে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম আজান দেন। তার শ্রুতিমধুর আজানের ধ্বনি সবারই প্রিয় ছিল। অনেকেই ভাবতেন হজরত বিলাল (রা.) আজান না দিলে পৃথিবীতে ভোর হবে না। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর আবেগের কারণে হজরত বিলাল (রহ.) আর আজান দিতে পারতেন না। বিশেষত ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ উচ্চারণের সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। মহানবী (সা.)-এর জন্য শোক সহ্য করতে না পেরে মক্কা-মদিনা ছেড়ে তিনি সিরিয়ার দামেস্কে চলে যান। কথিত আছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা মা ফাতেমা (রা.) এবং দৌহিত্র হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও হোসেন (রা.)-এর অনুরোধ এবং দামেস্কে সফররত দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর অনুরোধে হজরত বিলাল (রা.) আজান দেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হননি। মৃত্যুর আগে পরলোকে প্রিয় নবী (সা.)-এর সান্নিধ্য লাভের জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ৬৩৮ বা ৬৪০ সালের ২ মার্চ তার মৃত্যু ঘটে। দামেস্কের আল সাগির সমাধিতে তাকে সমাহিত করা হয়। পৃথিবীর অন্য কিছু অঞ্চলেও তার কবর রয়েছে বলে দাবি করেন স্থানীয় এলাকাবাসী। হজরত বিলাল (রা.) পৃথিবীতে থাকতেই বেহেশতে যাওয়ার সুসংবাদ পান স্বয়ং মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে।

 

সূরা লোকমানে উল্লিখিত পুত্রদের প্রতি লোকমান হাকিমের উপদেশ

১। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।

২। আল্লাহর কোনো শরিক কোরো না। শরিক করা চরম সীমালঙ্ঘন।

৩। পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার কর।

৪। আল্লাহর প্রতি ও পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।

৫। আল্লাহর কাছে সবাইকে ফিরে যেতে হবে।

৬। পিতা-মাতা যদি আল্লাহর শরিক করতে বলে, তবে তা মানবে না, কিন্তু পৃথিবীতে পিতা-মাতার সঙ্গে সম্ভাবে বসবাস করবে।

৭। যারা আল্লাহর পথে চলে, তাদের অনুসরণ কর।

৮। কোনো কিছু যদি সরিষার দানার পরিমাণও হয় এবং তা যদি পাথরের মধ্যে বা আকাশ বা মাটির নিচে থাকে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন।

৯। আল্লাহ দূরদর্শী ও সব বিষয়ে খবর রাখেন।

১০। নামাজ কায়েম কর।

১১। সৎকর্মের নির্দেশ দাও।

১২। বিপদে-আপদে ধৈর্যধারণ কর।

১৩। মানুষের সামনে গাল ফুলিও না।

১৪। অহঙ্কার করে মাটিতে পা ফেলবে না, সংযতভাবে ফেলবে।

১৫। আল্লাহ উদ্ধত ও অহঙ্কারীকে ভালোবাসেন না।

১৬। গলার আওয়াজ নিচু করে কথা বলবে, গর্দভের গলার আওয়াজই (পৃথিবীতে) সবচেয়ে শ্রুতিকটু (উচ্চ)।

 

আরও কয়েকজন আলোকিত কালো মানুষ

তারিক বিন জিয়াদ : ৭১১-৭১৮ সালে স্পেন ও পর্তুগাল জয়ে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন।

উম্মে আয়মান : মহানবী (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম দিককার নারী, যিনি মহানবী (সা.)- এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন ও যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা করতেন।

উবদা ইবনে আস সামিট : ইসলামের প্রাথমিক যুগে ধর্মান্তরিত হন, বদর ও ওহুদের যুদ্ধে অংশ নেন এবং মিসর জয়ে মুসলমান সেনাদের নেতৃত্ব দেন।

উসামা ইবনে জায়েদ : মহানবী (সা.)-এর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সাহাবি এবং ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ করেন।

সাদ আল আসওয়াদ : মহানবী (সা.)-এর সাহাবি, যিনি এক যুদ্ধে শহীদ হন। মহানবী (সা.) তার মৃতদেহ কোলে নিয়ে কেঁদে ছিলেন বলে বর্ণিত আছে।

জুলাইবিব : মহানবী (সা.) কে সার্বিক সেবা করতেন। মৃত্যুর পর মহানবী (সা.) স্বয়ং তার কবর গর্ত করেন এবং গোসল ছাড়াই সমাহিত করে তাকে শহীদ আখ্যা দেন।

মিহজা বিন সালেহ : মহানবী (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবি। বদরের যুদ্ধে প্রথম শহীদ মুসলমান।

সর্বশেষ খবর