এক হাতে গাছ, অন্য হাতে শাবল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একাকী। ফরিদপুর শহরে এমন দৃশ্য দেখা যায় হরহামেশা। তা ছাড়া ভ্যানে করে গাছ নিয়ে হাজির হন কোনো প্রতিষ্ঠানে কিংবা রাস্তার কাছে। প্রতিদিনই গাছ লাগান তিনি। শহরবাসীর এই চেনামুখটির নাম নুরুল ইসলাম। যাকে একনামে সবাই চেনেন ‘বৃক্ষপ্রেমী নুরুল স্যার’ হিসেবে। পেশায় তিনি সরকারি স্কুলের একজন সিনিয়র শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে গাছের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসার কারণেই গাছ লাগানো তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি অবসর সময়ে পড়ে থাকেন গাছ নিয়ে।
এ সময়ে গাছ লাগানো ও পরিচর্যায় সময় কাটান তিনি। গত কয়েক বছরে নিজ উদ্যোগে সড়কের পাশে, বিভিন্ন পরিত্যক্ত জমিতে, স্কুল-কলেজের আঙিনাসহ বিভিন্ন জায়গায় তাল, সুপারি, আম, দেশি খেজুর, কাঁঠালসহ বিভিন্ন প্রজাতির কমপক্ষে ২০ হাজার বীজ রোপণ করেছেন। তা ছাড়া গাছের চারা লাগিয়েছেন ১০ হাজারের মতো। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও বজ্রপাতের হাত থেকে রেহাই পেতে ইতোমধ্যে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স শাখা চত্বর ও শহরের বিভিন্ন সড়কের পাশে ১২ হাজার তালের বীজ রোপণ করেছেন। শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য রাস্তার কাছে ১০০টি সুপারি গাছের চারা রোপণ করেছেন। গত বছরও তিনি ২০০ সুপারির চারা রোপণ করেছিলেন। সেই গাছগুলো আজ রাস্তার কাছে ডানা মেলে উপরের দিকে উঠেছে। শিক্ষক নুরুল ইসলাম তাঁর ব্যক্তি উদ্যোগে শহরের জজ কোর্ট কম্পাউন্ড সড়ক হতে শুরু করে বিচারকের বাসভবনের সামনে দিয়ে ফরিদপুর স্টেডিয়াম গেট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এ সুপারির চারা রোপণ করেন। এর আগে শিক্ষক নুরুল ইসলাম ফরিদপুরের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ৪ হাজার খেজুরের বীজ রোপণ করেছেন। সেই সঙ্গে বজ্রপাতের হাত থেকে রেহাই পেতে ১২ হাজার তালের বীজ রোপণ করেছেন। জুলাই মাসে তিনি শহরের টেপাখোলা সহকারী পুলিশ সুপারের বাসভবনের সামনে থেকে শুরু করে কী পাইলাম মোড় পর্যন্ত রাস্তার ধারে জবা, বেলি, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, কাঁঠাল চাপা গাছ রোপণ করেন।
মহামারি করোনায় যখন মানুষ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পর্যন্ত পায়নি ঠিক সেই সময়েও শিক্ষক নুরুল ইসলাম তাঁর মোটরসাইকেলের পেছনে গাছের চারা নিয়ে শহর থেকে দূরের কোনো ফাঁকা জায়গায় গিয়ে নানা প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করেছেন। মানব জাতির পাশাপাশি পাখিদের কথা চিন্তা করেও শহরের টেপাখোলা যক্ষ্মা হাসপাতালের মোড় হতে শুরু করে ভাজনডাঙ্গা পর্যন্ত শহর রক্ষাবাঁধের ওপর বটবৃক্ষ রোপণ করেছেন। ফলে বটবৃক্ষে পাখি বাসা বাঁধতে পারবে এবং মানুষও এর ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। শিক্ষক নুরুল ইসলামের এমন কর্মযজ্ঞ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে। নুরুল ইসলাম নিজে গাছ রোপণের পাশাপাশি তাঁর সন্তান ও স্কুলশিক্ষার্থীদেরও গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। শহরের কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা তিনি। পরিবারে রয়েছে স্ত্রী, দুই পুত্র-কন্যা। বৃক্ষপ্রেমিক এ মানুষটি শুধু গাছ রোপণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। প্রতি মাসে তিনি অন্তত পক্ষে একটি ভালো কাজ করবেন বলেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। আর তাই গাছ লাগানোর পাশাপাশি তিনি প্রতিমাসে অসহায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে খাতা-কলমসহ শিক্ষা উপকরণ দিয়ে থাকেন। আবার কোনো সময় নিম্ন আয়ের মানুষকে চাল, ডাল, তেলসহ বাজার করে দেন। আবার কোনো ভিক্ষুক অথবা রিকশাচালককে নিয়ে তিনি বড় কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেতে বসেন। এভাবেই তিনি সমাজের অসহায় মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই গাছ লাগানোর প্রতি একটা আগ্রহ ছিল। সে সময় বাবার সঙ্গে বাড়ির আঙ্গিনায় গাছ লাগাতেন। তখন থেকেই গাছের প্রতি ভালোবাসা জন্মে তাঁর। তবে ২০১৯ সালের শুরু থেকে গাছ লাগানোর কার্যক্রম জোরালো করছেন তিনি। নুরুল ইসলাম আরও বলেন, তাঁর বেতনের একটি অংশ গড়ে প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা তিনি এই গাছ রোপণ ও পরিচর্যা কাজে ব্যয় করে থাকেন। গাছকে তিনি সন্তানের মতো ভালোবাসেন। সময় পেলেই নিজের লাগানো গাছের পরিচর্যা করে থাকেন। নুরুল ইসলাম বলেন, তাঁর এ কর্মকাণ্ডে পরিবারের কেউ কখনো রাগ হয়নি। বরং তাঁর এ সুন্দর কর্মযজ্ঞ সারা জীবন চালিয়ে যেতে পারেন পরিবার থেকে সেই সহযোগিতাও করছেন।