চলনবিল অধ্যূষিত পাবনার ভাঙ্গুড়ায় মাছ ধরার বাউত উৎসবে (স্থানীয় ভাষায়) হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে। হেমন্তের সকালে বিল অভিমুখে মানুষের ঢল, পূব আকাশে সূর্য উকি দেওয়ার অগেই বিলপাড়ে হাজারো মানুষ। ঘন কুয়াশার চাদরে কিছু বোঝা না গেলেও বিলে একে একে সবাই নেমে পড়ছেন, উদ্দেশ্য একটাই মাছ শিকার করা। প্রতিবছরের মতো শনিবার উপজেলার রহুলবিলে ভোর থেকে শুরু হয় এই কর্মযজ্ঞ, এটিই বাউত উৎসব। মাছ ধরার নানা উপকরণ নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা নানা বয়সী মানুষ মাছ ধরতে আসে বিলে। শৌখিন এসব মাছ শিকারিদের এ যেন এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে বিলপাড়।
ভোরের আলোয় রুহুল বিলের কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ। একেজন একেক ধরনের উপকরণ হাতে। কেউ পলো, ধর্মজাল, চাকজাল, ঠেলাজালসহ নানা ধরনের মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে সবাই নেমে পড়েছে বিলের পানিতে। কেউ শীতে জড়োসড়ো অবস্থায় বিল পাড়ে আগুন জ্বালিয়ে তা নিবারণের চেষ্টা করছেন আবার কেউ কেউ মাছ ধরতে পেরে আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে শীতকে বিদায় জানাচ্ছেন। এ উৎসব যেন এক মিলন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বিলপাড়ে আসা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার বেলদহ গ্রামের মুক্তার হোসেন মোল্লা জানান, পাবনার সীমান্তবর্তী রুহুল বিলে এসেছি শীতের রাতে মাছ ধরার আশায়। এই বিলে প্রতি বছর বাউৎ উৎসব হয়। এটা আমাদের এলাকার সবাই জানে, তাই শখ করে মাছ ধরতে এসেছি। শীতের ভেতর এসেছি ভাই, মাছ পেলে কোন শীতই লাগে না আমাদের।
পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর উপজেলার হাদল গ্রামের মিজানুর রহমান এসেছেন, তিনি নাকি মাছ মাছ কপালে মানুষ। আশেপাশের সব বিলেই যান তিনি ছোটবেলা থেকেই। বিলে বাউৎ নামার খবর পেলেই তিন ছুটে যান, তবে এ জীবনে যতবারই তিন বাউতে এসেছেন কখনো খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়নি তাকে। পলো দিয়ে ১২ কেজি ওজনের বোয়াল মাছ ধরারও অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়া গ্রাম থেকে খুব ভোরে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ৫ টি নসিমন নিয়ে তারা ৪৫ জনের মতো এসেছেন বাউতে মাছ ধরতে। কথা হয় তাদের সাথে তারা জানান, প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূর থেকে এখানে মাছ শিকার করতে এসেছি। আমাদের অধিকাংশই পলো নিয়ে এসেছি, মাছ পাবেন বলেই দাবী তাদের।
পাবনা-ফরিদপুর আঞ্চলিক সড়কের ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পাটুলিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অন্তত ২০টি বাস। এসব বাসে কুষ্টিয়া, নাটোর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন অনেক মৎস্য শিকারি। আবার অনেকে ইজিবাইক, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে এসেছেন। এরপর রুহুল বিল অভিমুখে ছুটে চলে মানুষ। ভোরের আলো ফোটার আগেই বিলপাড়ে হাজির নানা বয়সী হাজারো মানুষ। সবার হাতে মাছ ধরার নানা উপকরণ। একসঙ্গে বিলে নেমে লোকজ রীতিতে মনের আনন্দে চলছে মাছ শিকার। দলবেঁধে মাছ ধরার এ আয়োজনে মৎস্য শিকারিদের ডাকা হয় বাউৎ। তাদের ঘিরেই উৎসবের নামকরণ। চলন বিলাঞ্চলে এমন উৎসব চলছে যুগের পর যুগ।
খোঁজ নিয়ে আরোও জানা গেছে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নভেম্বরের শেষে অথবা ডিসেম্বরের শুরুতে মাসব্যাপি চলে এই উৎসব। সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ভোর থেকে বিলাঞ্চলের পূর্বনির্ধারিত এলাকায় দল বেঁধে মাছ শিকারে নামেন বাউৎ প্রেমিরা। চলনবিলের রুহুল বিল, ডিকশির বিল, রামের বিলসহ বিভিন্ন বিলে মাসব্যাপী চলে এই বাউত উৎসব। বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিল পাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। কে মাছ পেলেন, কে পেলেন না তা নিয়ে হতাশা নেই। তাদের কাছে আনন্দটাই বড় কথা।
এ বিষয়ে ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: নাজমুল হুদা বলেন, মাছের প্রজনন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না করে বাউত উৎসব পালন করতে হবে। এ বিষয়ে মৎস্য শিকারিদের সচতেন হতে হবে। সেইসঙ্গে বিলে গ্যাস ট্যাবলেট বা অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছের ও পরিবেশের ক্ষতি করছে এমন অভিযোগ পেলে মৎস্য আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি দাবি করেন।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা: নাজমুন নাহার বলেন, বাউত উৎসব এই এলাকার অতীত ঐতিহ্য, উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা হলো রুহুল বিল। শুনেছি প্রতি বছরের এই সব সময়ে এই বিলে মাছ ধরার উৎসব হয়। হাজার হাজার মানুষ আসেন বাউৎ উৎসবে যোগ দিতে।
তিনি আরো বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় বর্তমান সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাছের অভয়ারণ্য হিসাবে খ্যাত এই অঞ্চলের নির্ধারিত সীমারেখায় কোনো অসাধু মানুষ মাছ ধরতে না পারেন সে বিষয়ে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের নজরদারি রাখার তাগিদও দেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, এভাবে মাছ শিকার করায় মাছের ক্ষতি হলেও এ এলাকার এটা আদি উৎসব, বাধা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। তবে মাছের বংশবিস্তারের জন্য ক্ষতিকর।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল