বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

ইমদাদুল হক মিলন, কথাসাহিত্যিক, প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

ছোটগল্প বিষয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বই আছে। বইটির নাম ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় অত্যন্ত উঁচুমানের সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর উপন্যাস ‘শিলালিপি’ ও দুই খন্ডের ‘উপনিবেশ’ বাংলা সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠককে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর ছোটগল্প ‘টোপ’, ‘বনজোছনা’, ‘বনতুলসী’ ইত্যাদি ছোটগল্পের পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। ‘টোপ’ গল্পটি সৃষ্টি করেছিল ব্যাপক আলোড়ন। একালের জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার মনে করেন, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ১০টি গল্পের একটি ‘টোপ’।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। সমরেশ মজুমদার ছিলেন তাঁর সরাসরি ছাত্র। ‘দেশ’ পত্রিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় একসময় ‘সুনন্দর জার্নাল’ নামে কলাম লিখতেন। সেই কলাম ছিল তুমুল জনপ্রিয়। আর তিনি ছিলেন শিশুকিশোর সাহিত্যের এক বিশাল মহিরুহ। ‘পঞ্চাননের হাতি’ নামে তাঁর ছোট্ট একটি বই পড়ে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম, কতবার যে সেই বই পড়েছি বলতে পারব না। আর ‘উল্টোরথ’ বা ‘প্রসাদ’ অথবা ‘জলসা’ পত্রিকায় ‘নিশিযাপন’ নামে ছোট একটি উপন্যাস পড়ে দিশাহারা হয়েছিলাম। কী অসামান্য লেখা! এই পন্ডিত লেখকের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘টেনিদা’। বাংলা কিশোর সাহিত্যে ‘টেনিদা’ সিরিজটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশস্পর্শী।

এখন থেকে ৬০-৭০ বছর আগে পৃথিবীর যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ছোটগল্প পাঠ করে ফেলেছিলেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’। এ বইয়ের এক জায়গায় ছোটগল্প কী, তা বোঝানোর জন্য লিখলেন ‘রাজা মারা গেলেন, তারপর রানী মারা গেলেন’। ব্যাপারটা কী হলো? এ ব্যাপারটা হলো ঘটনা। এ ঘটনাটি কখন সাহিত্য হয়ে উঠবে তা বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখলেন, ‘রাজা মারা গেলেন, তার শোকে রানী মারা গেলেন’। এ ‘শোক’ হচ্ছে গল্পের থিম। এ থিমটিকে আশ্রয় করে ঘটনার সঙ্গে লেখক যুক্ত করবেন তাঁর কল্পনা, জীবনদর্শন, আবেগ, পরিস্থিতির বর্ণনা, চরিত্রচিত্রণ ইত্যাদি। ফলে তা একসময় গল্প হয়ে উঠবে। কিন্তু ‘রাজা মারা গেলেন, তারপর রানী মারা গেলেন’- এ বাস্তব ঘটনাটিকে আমরা সাংবাদিকতা বলতে পারি। যেখানে কল্পনার কোনো আশ্রয় নেই।  যেখানে বাস্তব ঘটনাটিই প্রধান।  পাঠককে শুধু জানিয়ে দেওয়া যে রাজার পর রানীও মারা গিয়েছিলেন।

আমার প্রধান পরিচয় আমি একজন সাহিত্যিক। ৫০ বছর ধরে গল্প-উপন্যাস, ছোটদের লেখা, টেলিভিশন, নাটক, কলাম ইত্যাদি বিস্তর লিখেছি। একসময় পেশা ছিল শুধুই সাহিত্যকর্ম। তারপর ঘটনাক্রমে যুক্ত হলাম সংবাদপত্রের সঙ্গে। হাতে-কলমে সাংবাদিকতার কোনো শিক্ষা আমার নেই। সাপ্তাহিক ‘রোববার’-এ জুনিয়র রিপোর্টারের কাজ নিয়েছিলাম ১৯৭৮ সালে। সে কাজ খুব বেশি দিন করিনি। ১৯৯০ সালে ছোটদের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছি বছর দেড়েক। কিন্তু সাংবাদিকতা বলতে সত্যিকারের অর্থে যা বোঝায় তা কখনো করিনি। বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করার সময় ফিচার ইত্যাদি লিখেছি; কিন্তু রিপোর্টিংয়ের কাজটি করিনি কখনো। ‘কালের কণ্ঠ’র সম্পাদক হওয়ার পর ধীরে ধীরে সাংবাদিকতার জায়গাটি বোঝার চেষ্টা করেছি। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কল্পনার কোনো স্থানই নেই। সাংবাদিকতা হচ্ছে কঠোর-কঠিন বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। সাহিত্যে থাকে কল্পনা, সাংবাদিকতায় থাকে কৌতূহল। কেন? এই কেনর উত্তর নিরন্তর খুঁজতে হয় সাংবাদিককে। একটি ঘটনা ঘটেছে, কেন ঘটেছে, নেপথ্যের কারণ উšে§াচন করাই সাংবাদিকের কাজ।

একটা সময়ে সাহিত্যের আলাদা ভাষা ছিল। সাংবাদিকতার ভাষাও ছিল আলাদা। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের নিত্যদিনকার মুখের ভাষাই হয়ে উঠল সাহিত্যের ভাষা, হয়ে উঠল সাংবাদিকতার ভাষা। আর পৃথিবীর বড় বড় লেখক যুক্ত হয়ে গেলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বহু রকমের কাজ করেছেন জীবনধারণের জন্য। সাংবাদিকতাও করেছেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কলম্বিয়ার গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে নিজের পত্রিকায় রিপোর্ট লিখতেন। বাংলা সাহিত্যের বহু বড় লেখক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাহিত্য ও সাংবাদিকতা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে। বাংলা সাহিত্যের অতি উঁচুমানের লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কৃষিবিষয়ক সাংবাদিকতা করতেন। মতি নন্দী করতেন ক্রীড়াবিষয়ক সাংবাদিকতা। লেখক-সাহিত্যিকদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পেশা হচ্ছে সংবাদপত্রে কাজ করা। সেটা মাঠ-ঘাট ঘুরে রিপোর্টারের কাজ হোক বা ফিচার বিভাগের কাজ হোক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা সময়ে প্রতিদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় নামে-বেনামে দু-তিনটি করে ফিচার লিখতেন। দেশ পত্রিকায়ও লিখতেন। কবিতা দিয়ে জীবন শুরু করে তারপর কথাসাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য লেখক হয়ে উঠলেন। আমাদের কবি শামসুর রাহমান সারা জীবনই সংবাদপত্রসেবী ছিলেন। দৈনিক বাংলার সম্পাদক হলেন, তারপর হলেন প্রধান সম্পাদক। সুতরাং সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই জীবনের পথে চলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির একটি প্রান্তর একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। একজন ছোটগল্পের লেখক, আরেকজন ঔপন্যাসিক সেখানে গেছেন। দুজনই সকালবেলা বেরিয়ে যান ঘর থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তর ঘুরে বেড়ান। সন্ধ্যাবেলা একত্র হন। দু-তিন দিন পর ছোট গল্পকারকে ঔপন্যাসিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই, দেখি তোমার নোটখাতা, তুমি কী কী নোট নিলে?’ গল্পকার বললেন, ‘আমি কোনো নোট নিইনি।’ ঔপন্যাসিক অবাক। ‘বল কী? নোট না নিলে তুমি লিখবে কী করে। এই যে দেখো আমার নোটখাতা পুরো ভরে ফেলেছি। যা যা দেখেছি সবই নোট নিয়েছি। ফিরে গিয়ে উপন্যাস লিখতে বসে যাব।’ ছোটগল্পকার বললেন, ‘তুমি কাল সকালে আমার সঙ্গে যাবে। আমি কী দেখেছি তা তোমাকে বলব।’ পরদিন একটি বিধ্বস্ত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। গল্পকার বললেন, ‘তুমি ওই বিধ্বস্ত বাড়িটির ভাঙা জানালার দিকে তাকাও।’  ঔপন্যাসিক তাকিয়ে দেখতে পেলেন, ভাঙা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আছে এক যুবতী। তার দুই গাল বেয়ে নেমেছে অশ্র“ধারা। গল্পকার বললেন, ‘এই মেয়েটির চোখের জলের মধ্য দিয়ে আমি পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটা দেখতে পেয়েছি। আমার কোনো নোট নেওয়ার দরকার নেই।’  ঘটনাটি এ জন্য বলা যে, ঔপন্যাসিকের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা সাংবাদিকদের বেশ ভালো রকম মিল আছে। গত শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এ জন্যই সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে দুই ক্ষেত্রেই অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে পেরেছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর