শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রতিদিন পড়তে পড়তে কেটে গেল ১০টি বছর

তসলিমা নাসরিন

প্রতিদিন পড়তে পড়তে কেটে গেল ১০টি বছর

এই পত্রিকার মালিক, সম্পাদককে আমি কুর্ণিশ করি। এত বাধা, প্রতিবন্ধকতা, এত হুমকি, এত হুঙ্কারের মধ্যেও... প্রতি সপ্তাহে ছাপিয়ে যাচ্ছেন আমার লেখা।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন ১০ বছরে পা দিচ্ছে। উৎসবের দিন বটে! কত শত উৎসব হয় দেশে, সব উৎসবেই আমার প্রবেশ নিষেধ। সবখানে, এক আমিই থেকে যাই অনাকাক্সিক্ষত, ব্রাত্য। মাঝে মাঝে ভাবি, যদি আমি হঠাৎ উপস্থিত হই দেশের কোনো এক উৎসবে, আমাকে দেখে লোকে নিশ্চয়ই ভূত দেখার মতো চমকে উঠবে। আমাকে নিয়ে লোকের ভয়ের সীমা নেই। ভয় মূলত আমার নাম নিয়ে। লেখা নিয়ে নয়। গত চার যুগ যা লিখেছি, সেসবই তো মেয়েরা এখন নির্বিঘ্নে লিখছে, লিখে প্রশংসা পাচ্ছে, পুরস্কার পাচ্ছে। অথচ এসবই, এই বক্তব্যই যখন নতুন ছিল, আমাকে একঘরে হতে হয়েছে, মার খেতে হয়েছে, নির্বাসনে যেতে হয়েছে।

হ্যাঁ, আমার নাম নিয়েই সমস্যা। ছদ্মনামে বই ছাপালে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু মিথ্যের আশ্রয় কোনো দিন নিইনি, নেওয়ার ইচ্ছেও নেই। আমার এই নাম থেকে প্রকাশক, সম্পাদক, আত্মীয়, স্বজন, পুরনো বন্ধুবান্ধব, চেনা-অচেনা লোকেরা- সত্যি কথা বলতে কী, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। দেশের পুস্তক প্রকাশকরা, যারা আমার একখানা বই ছাপানোর জন্য এক সময় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা অগ্রিম রয়্যাল্টি দিয়ে আসতেন আমাকে, অথবা পত্রিকার যে সম্পাদকরা আশায় আশায় থাকতেন আমার কলামের জন্য, তারা আমার নাম উচ্চারণ করতেই এখন ভয় পান। আমার পাওয়ার অব অ্যাটর্নির কাগজও সরকারি লোকের, যার সত্যায়িত করার কথা, করেন না। নামটির জন্য। নামটি রিফাত সুলতানা বা আবদুল হক হলে কোনো অসুবিধে হতো না কারোর।

মাঝে মাঝে অবশ্য লেখাও বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একটি অনলাইন পত্রিকায় গত কয়েক বছর আমি নিয়মিত কলাম লিখেছি। সেটি নানা অজুহাতে ইদানীং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করে, সে হয়তো তসলিমাকে কিছুদিন সহ্য করবে, খুব বেশি দিন করবে না।

আমি খুব ভালো করে জানি, আজ যদি শেখ হাসিনা আমার প্রশংসা করেন বা আমাকে আলিঙ্গন করেন, আমার বিরুদ্ধে প্রকাশক-সম্পাদক গোষ্ঠী যে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা চিরকালের জন্য জারি করে রেখেছেন, সেটি হাওয়ায় উড়ে যাবে। দেশের প্রকাশক এবং সম্পাদকদের অনেকেই আমার পাণ্ডুলিপি বা কলাম পাওয়ার জন্য আমাকে মুহুর্মুহু অনুরোধ করবেন, যেমন করতেন নব্বই দশকের শুরুর দিকে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছে। দেখে বড় দুঃখ হয়।

আসলে এত কথা বলছি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কথা বলব বলে। এ পত্রিকার মালিক, সম্পাদককে আমি কুর্ণিশ করি। এত বাধা, প্রতিবন্ধকতা, এত হুমকি, এত হুঙ্কারের মধ্যেও, এত শত্রু, এত নারীবিদ্বেষী, এত সন্ত্রাসী, এত কূপমণ্ডুক আর এত অসহিষ্ণু মানুষের হুমকি সত্ত্বেও প্রতি সপ্তাহে ছাপিয়ে যাচ্ছেন আমার লেখা। শুনেছি প্রথম প্রথম হুমকি আসত খুব, এখন অনেকটা কমেছে, অনেকেই নাকি বলছেন, লেখা ভালো লাগছে। এই যে পরিবর্তন, এটা সম্ভব হয়েছে, প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশকের দৃঢ় সংকল্পের জন্যই। লেখকের বাক স্বাধীনতায় তারা সত্যিই বিশ্বাস করেন বলে সম্ভব হয়েছে। যারা ভিন্ন মতে, বা মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করেন না, তারা, আমি মনে করি না কোনো পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার যোগ্য। এখন যারা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করছেন বা টেলিভিশনের চ্যানেল চালান, তারা অধিকাংশই, এক একটা রাজনৈতিক দলের মুখপত্র বা প্রচারযন্ত্র ছাড়া কিছু নন। মিডিয়াকে নিরপেক্ষ হতে হয়। ভিন্নমতকে জায়গা দিতে হয়। সুযোগ-সুবিধের প্রলোভনকে সংবরণ করতে হয়। তা না হলে সাংবাদিকের কাজে, যে যাই বলুক, কোনো গৌরব নেই। আমার কোনো দল নেই, সংগঠন নেই, আমি একা। আজ চার যুগ আমি নারীর অধিকার, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমতা, সততা, মুক্তচিন্তা, শিক্ষা, স্বনির্ভরতা ইত্যাদির পক্ষে লিখছি। আমার কলম কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র আমার লেখালেখির শুরু থেকেই চলছে। কিন্তু দমে যাইনি একটি দিনের জন্যও। আমার পাঠক আছে, কিন্তু পাঠকের কাছে আমার লেখা কেউ পৌঁছে দিতে রাজি নয়। বাংলাদেশ প্রতিদিন সেই দায়িত্বটি নিয়েছে। ঠিকই তো, ভালো লাগলে বলো ভালো, মন্দ লাগলে বলো মন্দ, ভুল হলে বলো ভুল, কোথায় ভুল দেখিয়ে দাও, বিতর্ক হোক। বিতর্ক ছাড়া কোনো সমাজ সামনে এগোতে পারে না। সবাইকে তুষ্ট করতে, সবাইকে খুশি করতে যে লেখালেখি, সেই লেখালেখি কোনো উপকারী লেখা নয়। মানুষের ভাবনার খোরাক জোগায় যে লেখা, যে লেখা মানুষকে আরও ভালো মানুষ হিসেবে গড়তে, এবং পুরনো পচা সমাজকে বদলাতে প্রেরণা দেয়, সেসব লেখাকেই আমি উপকারী লেখা বলি। উপকারী লেখাই তো লিখছি, কেন তবে তুমি আমার কণ্ঠরোধ করবে? কেন নাম-ধাম মুছে দেবে, যখন আমি ভীষণভাবে জীবন্ত? কেউ কেউ বলে মৌলবাদীদের ভয়ে। ভয় পেলেই মৌলবাদীরা ভয় দেখায়। ২৪ বছর আগে মৌলবাদীদের খুশি করতে আমাকে আমার দেশ থেকে খালেদা সরকার তাড়িয়ে দিয়েছিল বলে আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীরা এত নিশ্চিন্তে পথে নামতে পারে। হাসিনা সরকারও আমাকে দেশে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে বলে মৌলবাদীরা ভেবেই নিয়েছে আমার বিরুদ্ধে তাদেরও অন্যায় করার সব রকম অধিকার আছে। নিষেধাজ্ঞা জারি করে, অন্যদেরও নিষেধাজ্ঞা জারি করার অধিকার সরকারই দিয়ে দেয়।

একজন লেখক নির্বাসনে জীবন কাটালে মরে যায় না। কিন্তু একজন লেখকের লেখা না ছাপা হলে সে মরে যায়। দেশের সব দল, গোষ্ঠী, সব সংগঠন, সব প্রতিষ্ঠান আমার মৃত্যু রচনা করেছে, শুধু ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’, এক বাংলাদেশ প্রতিদিনই আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রতিদিনের সবাইকে আমার অন্তরের অফুরন্ত শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা। আজ প্রতিদিনের ১০ বছর। প্রতিদিন হাজার বছর বাঁচুক।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর