বর্তমান সরকার এক দারুণ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বলে শুনতে পাচ্ছি। সেটা হলো দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি মাল্টিসিনেপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। সিনেমার বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার এর চেয়ে বড় কোনো কাজ হতে পারে না। সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে আছি।
পত্রিকার পাতায় দেখলাম সিনেমা হল মালিকদের সংগঠন ঘোষণা দিয়েছে, এপ্রিলের ১২ তারিখ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য হল বন্ধ রাখবেন এবং এই দাবিটা আসছে, যখন গত এক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটা ছবি ভালো ব্যবসা করল এবং সামনে শাকিব খানের একটা ছবিও আসছে।
তাদের দাবি মূলত ভারতীয় ছবির অবাধ আমদানি করতে দিতে হবে। সিনেমা হলকে বাঁচানোর জন্য এটাকেই তারা একমাত্র ওষুধ হিসেবে দেখছেন। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরও একবার এই দাবি উঠিয়েছিলেন তারা। সেবার কী পরিস্থিতিতে সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো- সে আলাপে পরে যাচ্ছি।
প্রথমে বলে নেওয়া দরকার, সিনেমা হল মালিকদের যেন লোকসান দিয়ে হল না চালাতে হয় সেটা আমরাও চাই। সিনেমা হল মালিক এবং সিনেমা নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককেই একে অন্যের সংকট বুঝতে হবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যেন একচেটিয়া কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।
এবার আসি তাদের আবিষ্কৃত ওষুধ সম্পর্কে। তারা ভাবছেন ভারতীয় ছবি এলেই তাদের সব সমস্যার সমাধান হবে, তাতে অন্যের সমস্যা যাই হোক। বলে নেওয়া দরকার, এই দাবি করা হচ্ছে মূলত সিঙ্গেল স্ক্রিন থিয়েটারগুলোকে বাঁচানোর জন্য।
তাহলে আমরা একটু খোদ ভারতের দিকেই তাকাই। দেখি আমাদের সিঙ্গেল স্ক্রিনকে বাঁচাতে যাদের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে তাদের ওখানে সিঙ্গেল স্ক্রিনের কী অবস্থা। পশ্চিম বাংলাজুড়েই সিঙ্গেল স্ক্রিন থিয়েটার বন্ধের হিড়িক চলছে গত কয় বছর ধরেই। ২০১৫ সালে একযোগে চল্লিশটা সিঙ্গেল স্ক্রিন থিয়েটার বন্ধ হয়েছে পশ্চিম বাংলায়। ২০১৬ সালে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে। এটা শুধু ওই এক সালের বা কলকাতা শহরের ব্যাপার নয়। সিঙ্গেল স্ক্রিন যে ধুঁকছে এটা ক্রমাগত কয়েক বছরের ব্যাপার। প্রিয়া সিনেমা হলের মালিক অরিজিৎ দত্ত টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, তার মালিকানাধীন মফস্বলের পাঁচটা হলের লোকসান টানছেন প্রিয়া সিনেমা হলের আয় দিয়ে। ব্যারাকপুরের দেবশ্রী সিনেমা হলের মালিক কৌশিক সেন বলেছেন, ২০১০ সাল থেকেই তার হলে দর্শক কমতে থাকে এবং তিনি লোকসান গুনতে থাকেন সপ্তাহে এক লাখ টাকা।
এই হচ্ছে খোদ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা, যেখানে ভারতীয় ছবিই চলে, অন্য কিছু নয়। আমি জানি না বাঁচার জন্য পশ্চিমবঙ্গের ওইসব সিনেমা হলের মালিক কোন দেশের সিনেমা আমদানির দাবি তুলবেন!
সমস্যাটা বোধহয় এত সাদাকালো নয়, যতটা সাদাকালো ভাবছেন আমাদের হল মালিক ভাইয়েরা। তাদের ভাবতে হবে, কেন সিঙ্গেল স্ক্রিন উঠে যাচ্ছে আর মাল্টিপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের ভাবা দরকার, তারা সিনেমা হলের পরিবেশ ভালো করার জন্য গত দশ বছরে কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাদের ভাবা দরকার, সরকার তাদের কর রেয়াতের যত সুযোগ দিয়েছে হলের পরিবেশ আপগ্রেড করার জন্য, তারা কি সেই সুযোগটা যথাযথ কাজে লাগিয়েছেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে যখন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে সিনেমা হল উন্নয়ন কমিটি করা হলো এবং সেই কমিটি থেকে হলের আধুনিকায়নের জন্য তিন শ্রেণিকে ৬০ লাখ, ৪০ লাখ এবং ২০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার কথা বলা হলো তখন কি তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন? সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং ক্যাথরিন মাসুদ তো সেই কমিটিতে ছিলেন।
তারা আমাকে বলেছেন, বারংবার যোগাযোগের পরও কারও এ বিষয়ে আগ্রহই পাওয়া যায়নি। সমস্যার আসল জায়গায় নজর না দিয়ে ঝোপের আশপাশে পিটাতে থাকলে কারোরই কাজে আসবে না।
এবার আসি ভারতীয় সিনেমা আমদানি প্রসঙ্গে আমার পরিষ্কার অবস্থানে। বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্র নীতিমালা করার জন্য মতামত আহ্বান করলে আমি লিখিতভাবে সেখানে বলেছি, ভারতীয় সিনেমা আমদানি করা যেতেই পারে। কিন্তু সেটা একটা সীমার অধীনে থাকতে হবে। কোনো হলেই ভারতীয় ছবি মোট স্ক্রিনিং সøটের তিরিশ ভাগের বেশি চলতে পারবে না এবং সেই ছবি বাংলাদেশের ছবির মতো কর রেয়াতের সুযোগ পাবে না। এরকম একটা নীতির অধীনে ভারতের কেন, সারা পৃথিবীর ছবি আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য হতে হবে ভারতে আমাদের ছবি রপ্তানির ক্ষেত্রেও। সেখানে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে ন্যূনতম একটি রাজ্যে যেন বাংলাদেশের ছবি চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। ডিস্ট্রিবিউটর নিচ্ছে না, হল মালিক চায় না, এসব বলে বাংলাদেশের ছবি মুক্তির পথ বন্ধ করা যাবে না। যদি আদান-প্রদান না হয় তাহলে আমার তো দরকার নেই আপনার সঙ্গে চুক্তির। মনে রাখতে হবে, চুক্তি সব সময়ই দুই পক্ষের লাভের হিসাব করেই হবে এবং এটাও মনে রাখতে হবে, সিনেমা এবং টুথপেস্ট একই পণ্য নয়। সারা দুনিয়াতেই এমনকি ভারতেও টুথপেস্ট এবং সাংস্কৃতিক পণ্য আলাদাভাবে দেখা হয়। নিজের দেশের, নিজের রাজ্যের সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাই নানা নীতিমালা এবং কর রেয়াতের সুযোগ দেওয়া হয়।
আরও একটা কথা, শেলফ এবং সিনেমা হলের পার্থক্য ও রাজনীতিটা বুঝতে হবে।
শাহবাগের আজিজ মার্কেটে ভারত-চীন যে কোনো দেশের বই বিক্রি হতে পারে, নেটফ্লিক্সে হাজার হাজার ছবি একসঙ্গে থাকতে পারে, একটা টিভিতে ৬০টা চ্যানেল থাকতে পারে, সেখানে আমরা প্রতিযোগিতাও করতে পারি, কিন্তু সিনেমা হলে যদি বিদেশি ছবির জন্য স্ক্রিনিং সøট নির্দিষ্ট না করা হয়, তাহলে আমার দেশের সিনেমা শুক্রবারে হলই পাবে না! ভালো-খারাপ, প্রতিযোগিতা এসব তো দূরের কথা।
বাংলাদেশে গত কয় বছর ধরেই ধীরে ধীরে একটা নতুন ফিল্মমেকার প্রজন্মের আগমন ঘটছে। তারা প্রতি বছর বেশ কয়টা হিট ছবিও উপহার দিচ্ছে। এদের জন্য, দেশের সংস্কৃতির জন্য, সিনেমা নির্মাণ এবং প্রদর্শনের ব্যবস্থা জঞ্জালমুক্ত রাখা সরকারের দায়িত্ব। এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না যেটা এ ধারাকে বাধাগ্রস্ত করবে। মনে রাখবেন, ঢালাও হিন্দি ছবির বিরুদ্ধে লড়াই এখানকার সব ‘রিজিওনাল’ ভাষা ও সংস্কৃতির। যে কারণে এর আগেরবার যখন বাংলাদেশে ঢালাওভাবে হিন্দি ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের চেয়েও বেশি ফুঁসে উঠেছিল কলকাতার ইন্ডাস্ট্রি। যার শীর্ষ নায়ক বাংলাদেশের তখনকার মন্ত্রী মহোদয়কে ফোন করে বলেছিলেন, চিরতরে ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখা বন্ধ হয়ে যাবে যদি বাংলাদেশ এ সিদ্ধান্ত নেয়। এর কারণ তারা হিন্দির দাপটে দিশাহারা। কলকাতার বাংলা ছবিকে কর কাঠামোজনিত কিছু সুবিধা দেওয়া ছাড়া হিন্দি ছবিকে আটকানোর তো কোনো সুযোগ তাদের হাতে নেই, কারণ তারা তো বৃহৎ ভারতেরই অংশ। আমাদের তো আর সেই অবস্থা নয়। আমরা যদি বাংলা সিনেমার জন্য বাজার কাঠামোটা রক্ষা করতে পারি, যদি ধীরে ধীরে কন্টেন্টে পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ মিলে সিনেমার একটা বড় বাজার হতে পারে। এই ছিল কলকাতার ইন্ডাস্ট্রির উপলব্ধি। যার সঙ্গে আমিও একমত।
শেষ করব একটি কথা বলে, বর্তমান সরকার এক দারুণ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বলে শুনতে পাচ্ছি। সেটা হলো দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি মাল্টিসিনেপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। সিনেমার বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধার এর চেয়ে বড় কোনো কাজ হতে পারে না। সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে আছি।
লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা।