বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিরলস এক রাষ্ট্রনায়ক

প্রণব মুখার্জি

নিরলস এক রাষ্ট্রনায়ক
আজ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, সেদিন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই শুরু হয় ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তা আরও বাড়তে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে বার বার বাধার মুখে পড়েন তিনি। এ প্রক্রিয়ায় নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় তাঁকে। বিশ্বের বুকে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁকেই বাঁচতে দেয়নি দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা।
সেই শোকের দিন স্মরণে আমাদের এই বিশেষ আয়োজন।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তাঁর আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। তাঁর দাদার (ঠাকুরদা) ছোটভাই খানসাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটি মিডল ইংলিশ (এম ই) স্কুল খোলেন গোপালগঞ্জে। সে সময় ওই অঞ্চলে এই একটিই ইংরেজি শেখার স্কুল ছিল। অবিভক্ত বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম। একসময় শেখ পরিবার বিত্তবান ছিল, কিন্তু একটি ফৌজদারি মামলায় তাঁরা প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। মুজিব-পরিবারে ইংরেজি লেখাপড়া শুরু হয় তাঁর ঠাকুরদার আমলে। ঠাকুরদা মারা যান যখন, তখন মুজিবের আব্বা এন্ট্রান্স পড়েন। মুজিবের বিয়ে হয় যখন তাঁর নিজের বয়স মাত্র বারো বছর। স্ত্রীর ডাকনাম রেণু।

রেণুর আব্বার মৃত্যুর পর তাঁর দাদা (ঠাকুরদা) মুজিবুরের আব্বাকে ডেকে বলেন, তাঁর বড় ছেলের সঙ্গে তাঁর এক নাতনির বিয়ে দিতে হবে। কারণ, তিনি তাঁর সম্পত্তি দুই নাতনিকে দিয়ে যেতে চান। রেণুর দাদা ছিলেন মুজিবের আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্য রেণুর সঙ্গে মুজিবের বিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। মুজিবের বয়স তখন বারো। রেণুর তিন বা চার বছর। রেণুর দাদার মৃত্যুর পর রেণু মুজিবের মায়ের কাছে মানুষ হন।

১৯৩৪ সালে মুজিব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রায় দুই বছর তাঁর চিকিৎসা চলে। ১৯৩৬ সালে তাঁর গ্লুকোমা হয়। তখন তিনি ক্লাস সেভেনে। অসুস্থতার জন্য তাঁর পড়াশোনার মাঝে ছেদ পড়ে। ১৯৩৭ সালে আবার গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৯৩৮ সালে যখন তিনি ছাত্র, সে সময়ে বাংলার প্রথম প্রিমিয়ার শেখ ফজলুল হক এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসেন।

মুজিব সে সময় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। সেই বাহিনী গঠনের সময়ই তিনি লক্ষ্য করেন হিন্দু ছেলেরা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। কারণ, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছেন, হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের সাহায্যে মন্ত্রিসভা তৈরি করায় কংগ্রেস অসন্তুষ্ট। তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায় না। এই সময়ে সোহরাওয়ার্দী যখন মিশন স্কুল পরিদর্শনে গেলেন, সে সময় ছাত্র মুজিবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। মুজিব জানান, তাঁদের ওখানে মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগের কোনো সংগঠনই নেই। বিষয়টি সোহরাওয়ার্দী নোটবইয়ে টুকে নেন। সঙ্গে মুজিবের নামধামও। বলেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। ১৯৩৯ সালে মুজিব-সোহরাওয়ার্দীর ফের সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি সোহরাওয়ার্দীর কাছে গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগ গঠন করার প্রস্তাব দেন। এসবের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর বাবা সেই সময় ছিলেন মাদারীপুর মহকুমার সেরেস্তাদার।

১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে মুজিব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্বর ওঠে ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। জ্বর নিয়েই পরীক্ষা দেওয়ায় ফল প্রত্যাশামাফিক হলো না। তখনই তিনি রাজনীতিতে ঘোরতরভাবে জড়িয়ে পড়ছেন। তাঁর নিজের কথায়, ‘সভা করি, বক্তৃতা করি, খেলাধুলো করি না। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে। নতুবা মুসলিমদের বাঁচার উপায় নাই। খবরের কাগজ আজাদ যা লেখে তাই সত্য বলে মনে হয়।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

ম্যাট্রিক পাস করেই মুজিব কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তাঁর নেতৃত্বে ইসলামিয়া কলেজ বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে মুজিব বরাবরই গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ছাত্র ও যুবাদের নয়নমণি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি, ১৯৭১ সালের আগুনঝরা দিনগুলোতেও পূর্ব পাকিস্তান যখন উত্তাল, তখনো চার ছাত্রনেতা (আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন), যাদের ‘চার খলিফা’ বলা হতো, তারা সবর্দাই মুজিবের পাশে থাকতেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে মুজিব তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। ছাত্রলীগের প্রভাব সেই গণআন্দোলনে অপরিসীম ছিল।

মুজিব সম্পর্কে একটি রচনায় বলা হয়েছিল যে, তিনি হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে নক্ষত্রের অক্ষরে রচিত একটি নাম, যা আপন আলোতেই ভাস্বর হয়ে থাকবে। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে নিরলস কাজ করেছেন, পরিশ্রম করেছেন এবং পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পরও তাঁর লড়াই থেমে থাকেনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ সামনে রেখে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে।

খাজা নাজিমউদ্দিনের পরিবার মুসলিম আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। খাজা নাজিমউদ্দিন চল্লিশের দশকে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী হন। অবিভক্ত পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলও ছিলেন তিনি। খাজাসাহেব তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ঢাকার এই খাজা বংশ থেকেই ১১ জন এমএলএ হয়েছিলেন। ’৪৩ সালে নাজিমউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ছোটভাই খাজা শাহাবুদ্দিনকে শিল্পমন্ত্রী করেন। তখন দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে চলে আসছে। গ্রামে খাবার নেই, কাপড় নেই। ইংরেজ সরকার যুদ্ধের জন্য নৌকা বাজেয়াপ্ত করেছে। ধান-চাল সৈন্যদের জন্য মজুদ করে রেখেছে। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের কীভাবে উন্নতি ঘটানো যায়, সেই প্রসঙ্গে মুজিব একবার তাঁর আত্মজীবনীতে সুভাষ চন্দ্র ও চিত্তরঞ্জন দাশকে উল্লেখ করে বলেন, বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা ও বিপ্লবীরা, যারা দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন, তাঁরা যদি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি এবং বিশেষ করে, হিন্দু বেনিয়া কুশীজীবী জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতেন, তাহলে অবিভক্ত বাংলায় যেভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি হয়ে পাকিস্তান তৈরিতে সাহায্য করেছিল, তা সম্ভব হতো না।

 

মৌলানা আজাদও তাঁর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থে লিখেছেন- জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাশই উপলব্ধি করেছিলেন বৃহত্তর মুসলমান সমাজকে কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগপত্র দিতে হবে এবং শুধু তত্ত্বেই নয়, বাস্তবেও কলকাতা করপোরেশনের নতুন পদ আশি শতাংশ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত করেছিলেন।

কিন্তু মুজিবের রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ চক্রান্তের শিকার হলেন। যদিও শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১২৪টি আসনের মধ্যে ১১৯টি পায় মুসলিম লীগ। ফজলুল হকের নেতৃত্বে চারটি আসনে জিতে কৃষক প্রজাপার্টি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের সুপ্রিমো সোহরাওয়ার্দীকে সরিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হলো। যে সভায় খাজা পূর্ব পাকিস্তানের নেতা নির্বাচিত হলেন, সেই সভায় মুসলিম লীগের অবজারভার ছিলেন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগড়। তিনি জিন্নাহর একান্ত বিশ্বাসভাজন ছিলেন।

যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য মুজিব আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, গ্রামে গ্রামে প্রচার করে মুসলিম লীগ এবং ছাত্রলীগের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ১৯৪৭ সালেও সিলেটে গণভোটের সময় ব্যবসায়ী রণদাপ্রসাদ চৌধুরীর সহায়তায় স্টিমার নিয়ে পাকিস্তানের স্বপক্ষে প্রচার করে শেষ পর্যন্ত শ্রীহট্টের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি বাস্তবায়িত করেছেন, সেই মুজিবের সঙ্গেই লীগ নেতৃত্বের ক্রমশ তীব্র মতভেদ শুরু হয়। বিভিন্ন নীতি এবং তার প্রয়োগ নিয়ে বিরোধিতা করতে শুরু করেন তিনি। সে কারণে স্বাধীনতার অল্প পরেই বিভিন্ন সময়ে সরকারি নীতির সমালোচনা ও বিরোধিতা করে কারারুদ্ধ হন। ১৯৭১ সালের নয় মাস যোগ করলে মুজিবের কারাজীবন-দিনের হিসাবে ৩ হাজার ৫৩ দিন! জেলে বসেই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছেন, যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর ২৯ বছর পরে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ভূমিকায় লিখেছেন- ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে যে ভয়ানক গ্রেনেড হামলা হয় এবং লীগের ২৪ জন নেতা মৃত্যুবরণ করেন, সেই সময়েই এই খাতাগুলোর চারটি তিনি হাতে পান। এই খাতাগুলো তাঁর এক ফুফাতো ভাই তাঁর হাতে তুলে দেন। খাতাগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাগনে ‘বাংলার বাণী’র সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিস টেবিলের ড্রয়ারে। সম্ভবত মুজিব তাকে এই খাতাগুলো দিয়েছিলেন টাইপ করার জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিবের সঙ্গে শেখ মণির বাড়িতেও আততায়ীরা আক্রমণ করে। তিনিও সপরিবার নিহত হন। সেই খাতাগুলো থেকেই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থিত হয়েছে।

মুজিবুর রহমানের বিশাল কর্মময় জীবন যা তাঁর ধৈর্য, মানসিকতা, দৃঢ়তা এবং অপরিসীম আত্মসংযমের পরিচায়ক, তার সামগ্রিক মূল্যায়ন করা দুরূহ। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের রাতে মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী করাচিতে বন্দী হিসেবে নিয়ে আসে। করাচি বিমানবন্দরে দুজন মিলিটারি অফিসারের সঙ্গে তোলা তাঁর ছবি বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে ছিলেন। সেটি রাওয়ালপিন্ডির কাছে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের কোনো খবর তাঁর কাছে ছিল না। এই সময়ে মানসিক এবং শারীরিক চাপ তৈরির জন্য প্রচ- গরম এবং নিদারুণ ঠা-ার মধ্যে প্রায় নয় মাস তাকে রাখা হয়। একটি মাত্র কম্বল শীত নিবারণের জন্য দেওয়া হয়েছিল। কোনো ডাক্তারি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়নি। একজন মিলিটারি অফিসার হিসেবে জেল গভর্নর মাঝে মাঝে আসতেন। যুদ্ধের খবরও তাঁর কাছে ছিল না।

জেলে বসে আকাশে যুদ্ধবিমানের ব্যস্ততা দেখে এবং মিলিটারি প্রহরীদের নিজেদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তিনি আভাস পেতেন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বোধ হয় যুদ্ধ হচ্ছে। ডিসেম্বর ২৬ পর্যন্ত এই কারাগারেই বন্দী ছিলেন তিনি। তারপর শেষরাতে জেল গভর্নর একটি ট্রাকের মধ্যে করে খড়ের ওপর শুইয়ে পাহাড় এবং জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রবল বৃষ্টির মাঝে তাকে কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আসেন। তিনি এটুকুই বলেন, ‘জেলে আপনার জীবন বিপন্ন। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ এ ছাড়া কোনো সংবাদ তাকে দেওয়া হয় না। তবে তাকে একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন বাংলোয় (যেটি ছিল জেলারের অফিশিয়াল রেসিডেন্স) নিয়ে আসা হয়। স্নানের সুযোগ, শীতনিবারক বস্ত্র, শেভিং কিটসহ কিছু সুবিধাও দেওয়া হয়, যেসব থেকে তিনি নয় মাস বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি অথবা টেলিফোন ব্যবহার করার সুযোগ তাকে তখনো দেওয়া হয় না। পাঁচ দিন পর অর্থাৎ, ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বিকালে তাকে একটি স্টাফ কারে করে দুজন মিলিটারি অফিসার আরেকটি বাংলোয় নিয়ে আসেন। সেটি ছিল রাওয়ালপিন্ডি থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে বিকালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ভুট্টো নিজেই বলেন, তিনি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিবুরের সহযোগিতা চান। ১ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই কদিন ভুট্টো বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন এবং চাপ সৃষ্টি করেন যাতে তিনি ভুট্টোর সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে সই করেন। অনেকগুলো খসড়া তিনি মুজিবকে দেখান। মুজিব প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলেন তিনি জেল থেকে মুক্ত কিনা। নাকি মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে আসলে অন্য কারাগারে বন্দী হয়েছেন, যেখানে জীবনযাত্রা আরামপ্রদ এবং সুসহ। এখানে থাকার সময়েই তিনি খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু কাগজ এবং পত্রপত্রিকা যেগুলো তাঁর কাছে পৌঁছত, সেখানে বিভিন্ন সংবাদ কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ‘টাইম’ পত্রিকার একটি কপি তাঁর হাতে পৌঁছায়, যেটিতে কাটাকুটি ছিল না। সেখানে একটি প্রবন্ধে মুজিব দেখেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিব আগামী দিনে দেশের কোন কোন সমস্যার ওপর জোর দেবেন তা নিয়ে একটি আলোচনা রয়েছে। পাশাপাশি একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, মুজিব কোথায়? যদি জীবিত থাকেন তাহলে একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে কীভাবে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী রাখা হয়? আরও অনেক বিষয়ে আলোচনা সেখানে তিনি দেখতে পান।

এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য মুজিবের কাছে বার বার আবেদন করেন। যে সম্পর্ক পাকিস্তানের অখ-তা বজায় রাখবে। মুজিব শুধু জানান, তিনি তার দেশের মানুষের সঙ্গে কথা না বলে ভুট্টোর সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত ভুট্টো হতাশ হয়ে মুজিবকে ব্রিটেনে পাঠানোর মনস্থ করেন। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের মাঝরাতে তাকে পাক এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ বিমানে একটি মাত্র যাত্রী হিসেবে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনের হিথ্রোয়। তিনি যখন হিথ্রোয় নামেন স্থানীয় সময় তখন ভোর সাড়ে ৬টা। তার আগেই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে হিথ্রো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে যে, মুজিবকে নিয়ে একটি বিমান নির্দিষ্ট সময়সূচি ছাড়াই লন্ডনে পাড়ি দিয়েছে। যেন ওই বিমানকে নামতে দেওয়া হয় এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে এই সংবাদটি জানানো হয়। সরাসরি ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা হিথ্রো থেকেই তাকে নিয়ে ক্ল্যারিজস হোটেল পৌঁছান এবং খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালিরা ওই হোটেলে এসে মুজিবের সঙ্গে দেখা করে নিজ নিজ প্রাপ্ত সংবাদ জানাতে থাকেন। মুজিব দেশের খবর পান। অবশ্য ভুট্টো কথা প্রসঙ্গে আগেই তাকে জানিয়েছিলেন, তার পরিবারের সবাই জীবিত রয়েছেন। পিতা-মাতা পর্যন্ত।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা লেখালেখি তার মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণামূলক কাজ চলছে এবং বহুদিন চলবে। তিয়াত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখায় একটি নোটবইয়ে তাঁর একটি মন্তব্যের বঙ্গানুবাদ দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। এই উদ্ধৃতির মধ্যেই তাঁর পরিপূর্ণ পরিচয় বিধৃত রয়েছে- “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে”।

 

লেখক :  ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর