‘ক্যাম্পাসে হাত বাড়ালেই সিগারেট। তাই শুরুটা সিগারেট থেকেই। ধীরে ধীরে সিগারেট পরিণত হয় নেশায়। সিগারেট না খেলে ভালো লাগে না। এরপর বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে প্রথমে গাঁজা। তারপর মদ, ফেনসিডিল, সবশেষে আসক্ত হই মরণনেশা ইয়াবায়। এখন নিজের অভিশপ্ত জীবনের প্রতি চরম হতাশা আর তিক্ততা। অসৎ সঙ্গ আর সামান্য সিগারেটই উল্টো দিকে মোড় নিয়েছে জীবনের গতি।’
এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কলা অনুষদভুক্ত একটি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নুরুল হাসনাঈনের (ছদ্মনাম) জীবনের লোমহর্ষক গল্প!
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রায় সকল শিক্ষার্থীই ক্যাম্পাসের মুক্ত বিহঙ্গে ডানা মেলে ওড়ার সুযোগ পান। তাই শুধু হাসনাঈনই নয়। তারমত রাবি ক্যাম্পাসের অসংখ্য ফুটন্ত মেধাবী গোলাপ প্রথমে সিগারেট তারপর মরণনেশায় আসক্ত হয়ে ঝড়ে পড়ার নজির রয়েছে অহরহ।
ক্যাম্পাসে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩০৩.৮০ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অন্তত ৭০টি দোকানে (পয়েন্ট অব সেল) সিগারেট পাওয়া যায়। ধূমপান ও তামাকপণ্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, তামাকপণ্যের দোকানে (সিগারেট, গুল, জর্দ্দা পাওয়া যায় এমন যে কোনো দোকান) ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে সতর্কীকরণ বাণী থাকার কথা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এই ৭০টি দোকানের অধিকাংশগুলোতেই এমন সতর্কীকরণ বাণী নেই। বরং উল্টো বিভিন্ন সিগারেট কোম্পানির আইন বহির্ভূত বিজ্ঞাপন (ধূমপানে প্রলুব্ধকরণ বিজ্ঞাপন) আর পুরস্কারে (সিগারেট কোম্পানি গুলো থেকে দেয়া সিগারেট রাখার শো-ক্যাশ) ভরপুর।
সরেজমিনে দেখা গেছে- ক্যাম্পাসের টুকিটাকি চত্বর, পরিবহন মার্কেট (আমতলা), পুরাতন ফোকলোর চত্বর (ইবলিশ চত্বর), রাবি বাস স্ট্যান্ড (মিলনায়তনের সামনে), শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে (দক্ষিণ পাশে), ডীন্স কমপ্লেক্সের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে, রবীন্দ্র ভবনের পূর্ব ও দক্ষিণ গেটের সম্মুখে, মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের দক্ষিণ গেটের সামনে, বিজ্ঞান ভবনগুলোর সামনে, চারুকলা গেইট ও এর আশেপাশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন বাজার এবং ১১টি ছাত্র আবাসিক হলের সামনে বিভিন্ন খাবার ও চায়ের দোকানে ছাত্র- শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বহিরাগতরা দেদারছে ধূমপান করছে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ধূমপানমুক্ত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই এর অভ্যন্তরেই করছেন ধূমপান। এমনকি বিভিন্ন একাডেমিক ভবন, দপ্তর এবং আবাসিক হলগুলোতেও অনায়াশেই ধূমপান করা হচ্ছে।
মোটকথা, পুরো ক্যাম্পাস ধূমপায়ীদের ধূমপানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এতে যারা ধূমপান করছেন তারা ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি আশেপাশের লোকজনেরও (সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং) চরমভাবে ঘটছে স্বাস্থ্যহানি। ফলে সবুজ ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত রাবি ক্যাম্পাসের নির্মল বায়ু প্রতিনিয়ত হচ্ছে দূষিত আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নন স্মোকাররা।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অনুষদের ৫৮টি বিভাগের প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী এবং প্রায় দেড় হাজার শিক্ষককে বিশেষ করে অধূমপায়ীদের বিষয়টি চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, শিক্ষক-ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা দোকানদার কোনো ভেদাভেদ নেই। ক্যাম্পাসের যত্রতত্র সবাই একসঙ্গে বসে দেদারছে ধূমপান করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, ‘ক্যাম্পাসে যত্রতত্র ছাত্র-শিক্ষক একসঙ্গে বসে ধূমপান করছে। এতে অধূমপায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো চায়ের দোকানে বসলে সিগারেটের ধোঁয়ায় টিকে থাকা দায়। ক্যাম্পাসজুড়ে সিগারেটের দোকান থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রথমে সিগারেটে তারপর বিভিন্ন ধরনের মরণনেশায় আসক্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেন অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণ করতে পারি এজন্য ক্যাম্পাসকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা উচিত। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে যারা ধূমপান করবে তাদের শাস্তিরর জন্য একটি আইন পাস করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।’
স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন ‘বাঁধন’ এর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ইউনিটের উপদেষ্টা এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘মাননীয় উপাচার্য রাবিকে দেশের প্রথম ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছেন। আমাদের দাবি, রাবিকে ডিজিটাল ক্যাম্পাস ঘোষণার আগে ধূমপায়ীদের সিগারেটের ধোঁয়া থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করতে হবে।’
বিতর্ক সংগঠন ‘গোল্ড বাংলাদেশ’ এর বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মো. সোহরাব হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু অধূমপায়ী শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষে ভর্তি করানো হয়েছে। রাজশাহী কলেজকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দাবি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কেও ধূমপানমুক্ত ঘোষণার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।’
ক্যাম্পাসের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর রাখার জন্য শিক্ষকগণও রাবি ক্যাম্পাসকে ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে দেখতে চান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফামের্সী বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে ক্যাম্পাসের যত্রতত্র ধূমপান করার কোনো নজির নেই। আমাদের দেশেই এটি বিরাজমান। এতে ক্ষতিকর নিকোটিনের মাধ্যমে প্যাসিভ স্মোকাররাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাজেই আমরা চাই, ক্যাম্পাস পুরোপুরি ধূমপানমুক্ত হোক। অন্ততপক্ষে ক্যাম্পাসে দুই-একটি স্মোকিং জোনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেখানে গিয়ে ধূমপায়ীরা ধূমপান করবে। এতে অন্তত অধূমপায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাবি ক্যাম্পাসকে ধূমপানমুক্ত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যায়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা পুরো বাংলাদেশ ধূমপানমুক্ত হোক এটা কামনা করি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (আইন প্রয়োগকারী সংস্থা) প্রথমে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন