সতেরো পেরিয়ে আঠারোতে পা দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পার হলেও শিক্ষার্থীরা হল পেয়েছেন মাত্র একটি। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পুরনো হলগুলো উদ্ধার এবং সংস্কারের দাবি এখনও অপূর্ণই রয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সীমাবদ্ধতার চাপা কষ্ট নিয়েই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করছে।
বৃহস্পতিবার সকালে পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো ইমদাদুল হক।
জানা যায়, ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্মস্কুল থেকে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। কিন্তু এখনও ছাত্রাবাসসহ অন্যান্য মৌলিক সমস্যা থেকে বঞ্চিত রয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মাত্র ১২০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এই হলে ছাত্রীরা ওঠেন চলতি বছরের মার্চের শুরুতে।
এই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী বর্ণালী সাহা বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে খুব সহজেই অংশগ্রহণ করতে পেরেছি হলে থাকার কারণে। আগে আমি সাভার থেকে বাসে আসতাম। ঐখানে থাকলে আজ আসতে পারতাম না।
নিজের এই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সেইসব বন্ধুদের কষ্টের কথাও বর্ণালী বলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
“হলে থাকায় আমরা কিছুটা হলেও ভালো আছি। কিন্তু আমাদের বন্ধুদের কিন্তু সে সুযোগ নেই৷ তারা মেসে অনেক কষ্টে থাকে, কর্তৃপক্ষের উচিত সেদিকে নজর দেওয়া।"
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের আওতায় ৩৬টি বিভাগ এবং ২টি ইনস্টিটিউট আছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।
ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আরেক শিক্ষার্থী প্রিয়তা মনি বলেন, ‘আসলে আরও হল নির্মাণ করা উচিত। একটা হলে তো খুব বেশি শিক্ষার্থী থাকার সুযোগ নেই। আর আমাদের বিশ্ববদ্যালয়ে একটা কিছু শুরু করা মানে কয়েক যুগ কেটে যায়। তাই দাবি জানিয়েও আসলে কোনো লাভ নেই৷"
আরও জানা যায়, শিক্ষার্থীদের আবাসনসহ নানা সংকট সমাধানে ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। ২০০ একর জমির ওপর এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল।
তবে নতুন ক্যাম্পাসের ২০০ একর জমির মধ্যে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি বুঝিয়ে দেয় ঢাকার জেলা প্রশাসন। হস্তান্তর বাকি রয়েছে ১১ দশমিক ৪০ একর জমি। শেষ হয়নি সীমানপ্রাচীরের কাজও। কয়েক ধাপ বাড়িয়ে সেই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত গড়িয়েছে।
এছাড়াও জানা যায়, পুরান ঢাকার বিভিন্ন পরিত্যক্ত বাড়িতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা যেসব ছাত্রাবাস তৈরি করেছিল, ১৯৮৫ সালের পর থেকে সেগুলো একে একে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যেতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কয়েক দফা আন্দোলনের মুখে হল উদ্ধারে সরকার একাধিক কমিটি গঠন করলেও বেদখল হওয়া ১১টি হলের মধ্যে দুটি ছাড়া বাকিগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও কর্মচারী এসব পুরনো ভবনে থাকলেও কোনোটিই এখন আর বসবাসের উপযোগী নয়।
হল উদ্ধারে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক ছাত্রনেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের তীব্র আবাসন সংকট থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব স্থাপনার উন্নয়ন হয়নি।
আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সরকারের বরাদ্দ ও নির্দেশনা ছাড়া হলগুলোর পরিকল্পনায় যেতে পারছেন না তারা।
শতবর্ষী জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী নিরীক্ষা করে বিলুপ্ত কলেজের যে সম্পত্তির হিসাব বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই ছিল তখন বেদখলে।
ক্যাম্পাসের সীমানার বাইরে কেবল ধূপখোলার খেলার মাঠটিকেই নিজেদের কর্তৃত্বে পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে গেল বছর বিশ্ববিদ্যালয় সেটাও হারায়।
এই মাঠেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করে আসছিল কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনের আয়োজন হয়েছিল সেখানে, তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখন সাড়ে সাত একর আয়তনের মাঠটিকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করে সেখানে মার্কেট তৈরির কাজ করছে।
প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্বিবদ্যালয় হিসেবে গড়ে না উঠায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘ক্যাম্পাসে এসে তো কতকিছু হবে শুনছি। কিছুই কিন্তু হচ্ছে না। আমাদের পড়াশোনার চেয়েও মূল চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ উপার্জন। বিশ্ববিদ্যালয়টা আবাসিক হলে কিন্তু আমাদের পয়সার পিছনে ছুটতে হত না। পড়াশোনায় তখন পূর্ণাঙ্গ মনোযোগ দেওয়া যেত। অন্তত কয়েকটা হল দ্রুত বানানো উচিত।’
ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবুল বাশার বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে আমার এক ভাই পড়ছেন এখানে। তার সময় থেকে শুনতেছি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এখনো কিছুই হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিক হলে এত সময় লাগার কথা না। কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের অনুরোধ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষার্থীর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে তারা যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্মস্কুল নামে এটি যাত্রা শুরু করে। ১৮৭২ সালে স্কুলটির পরিচালনার দায়িত্ব পায় বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। তিনি পিতার নামে স্কুলটির নতুন নাম হয় ‘জগন্নাথ স্কুল’। এভাবেই ১৮৭২ সালে ব্রাহ্মস্কুল থেকে জন্মলাভ করে জগন্নাথ স্কুল। ১৮৮৪ সালে এ স্কুলকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে রূপান্তর করা হয়। তখন এর নাম বদলে করা হয় ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ’। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৭ সালে শিক্ষা বিভাগের নির্দেশে স্কুল ও কলেজ শাখা আলাদা করা হয়। ১৯০৮ সালে জগন্নাথ কলেজ প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে কলেজটিতে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়। জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে এটিকে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে অবনমিত করা হয়। জগন্নাথ কলেজের সকল শিক্ষার্থী ও গবেষণাপত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়।
পুরান ঢাকায় নারী শিক্ষার বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা চালু হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৮ বছর পর ১৯৪৯ সালে আবার এই কলেজে শুরু হয় স্নাতক পর্যায়। ১৯৬৩ সালে পুনরায় সহশিক্ষা চালু হয়। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারীকরণ করা হলেও পরের বছর এটি আবার বেসরকারি মর্যাদায় ফিরে যায়। ১৯৭৫ সালে এতে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি জগন্নাথ কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। সবশেষ ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫' জাতীয় সংসদে পাশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন