করোনা মহামারির কারণে থমকে যাওয়া প্রাণ ও প্রকৃতি ফের পুরনো রূপে ফিরতে শুরু করেছে। দীর্ঘ এক বছরের ভয়-ভীতি, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে মানুষও দিন দিন স্বাভাবিক হচ্ছে। প্রকৃতিতেও এসেছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মধ্যেই রবিবার শুরু হচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত মাস। একই দিনে আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
এ দুইয়ে মিলে এবার শিমুল বাগানে উৎসব হচ্ছে, প্রাণে প্রাণে মিলেছে প্রাণ। ফুলের সৌরভে মেতে উঠেছে চারপাশ। গাঁদা ফুলের রঙেই সেজেছে তরুণীরা। পড়েছে বাসন্তী রঙের শাড়ি। খোঁপায় গুঁজেছে শিমুল ফুল, মাথায় টায়রা আর হাতে পড়েছে কাচের চুঁড়ি। তরুণরাও বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পরে এসেছে শিমুল বাগানে। বাগানের প্রতিটি গাছে এসেছে শিমুল ফুল। বেড়েছে সৌন্দর্য। সব মিলিয়ে শীতের আড়ষ্টতা ভেঙে বসন্ত আর ভালোবাসায় মিলেমিশে একেকার।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বসন্তের সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতি নিজ রূপে সেজে উঠেছে শিমুল ফুল। এবার করোনাকে উপক্ষে করে বাগানের চারপাশ ফিরে পেয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। এবার যেন প্রকৃতি একটু বেশিই সেজেছে। ভেঙেছে শীতের আড়ষ্টতা। গাছে গাছে এসেছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচি পাতার ধীর গতিময় বাতাস জানান দিচ্ছে নতুন লগ্নের। ফাল্গুনের আগমনে পলাশ, শিমুল গাছে লেগেছে আগুনে খেলা।
জানা যায়, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মানিগাঁও গ্রামে ২ হাজার ৪ শতক জমিতে গড়ে উঠা শিমুল বাগানের প্রতিটি গাছে এসেছে নতুন ফুল। রূপ আর সম্পদের নদী যাদুকাটার তীরে ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই শিমুল বাগানই দেশের সবচেয়ে বড় জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগান। দেশের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত নদী যাদুকাটার তীরে ঘেঁষে উঠা শিমুল বাগানে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ফুল ফুটতে শুরু করে। লাল ফুলের কারণে পুরো এলাকায় হয়ে উঠেছে রক্তিম আভা। ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে, মাঝে সৌন্দর্যে ষোলো কলায় পরিপূর্ণ যাদুকাটা নদী, এপারে শিমুল বাগান। সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। লাল পাপড়ি মেলে থাকা রক্তিম আভায় যেন পর্যটকদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।
এদিকে, ফাগুন আসার আগে আগেই স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তাহিরপুরে পর্যটকরা আসতে শুরু করেছেন। আসছেন পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এতে বেড়েছে পেশাদার ফটোগ্রাফারদের ব্যস্ততা। পাশাপাশি ব্যস্ততা বেড়েছে শিমুল ফুল দিয়ে মালা, ভালোবাসার প্রতীক তৈরি করার কারিগরদের মধ্যেও। বসন্তের আগমনী বার্তা জানিয়ে সারি সারি শিমুল গাছে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। বাগানের সবকটি গাছে পরিপূর্ণ ভাবে ফুল ফুটতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে হয়তো।।
সিলেট থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা পিংকু ধর জানান, শিমুল বাগানে অনেক দিন ধরে আসার পরিকল্পনা ছিল। আজ (রবিবার) পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছি। দীর্ঘপথ জার্নি করে এখানে পৌঁছে সব ক্লান্তি ভুলে গেছি। আর শিমুল বাগানের সৌন্দর্য সত্যিই মুগ্ধ করবে যে কাউকে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় অনেকটাই ভুগিয়েছে এটুকু পথ আসতে গিয়ে।
শিমুল বাগানে ঘুরতে আসা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী বলেন, সারি সারি রক্তা রাঙা শিমুল ফুল দেখে সত্যিই অভিভূত। তবে বাগানের সব ফুল এখনও ফুটেনি। ৩-৪ দিন পরে আসলে আরও অনেক সৌন্দর্যের দেখা মিলতো।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পিংকা ও জান্নাতুল বলেন, আমরা ৭ জন বন্ধুবান্ধব শিমুল বাগানের সৌন্দর্য দেখতে গত বছর পরিকল্পনা করেছিলাম। আজ বাগানে আসতে পেরে এবং এর সৌন্দর্য দেখে সত্যিই মুগ্ধ। তবে যাত্রাপথে নাজেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে আমাদের। যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যতীত এ এলাকার সব কিছুই ভালো লেগেছে। আবারও আসার ইচ্ছে আছে।
চিকিৎসক হাসনা হেনা বলেন, স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে শিমুল বাগান দেখতে এসেছি। এসে যা দেখলাম তাতে মনে হলো, পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তাহিরপুরে। তবে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও এর প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটছে আর এ পর্যটন সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল করে রাখতে হলে প্রথমেই পর্যটকদের মানসম্মত থাকা-খাওয়া ও নাজেহাল যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।
বাগানের প্রতিষ্ঠাতা মহুরম জয়নাল আবেদীনের ছেলে বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন বলেন, তার বাবার পরিশ্রমের ফসল এই বাগানটি। তিনি খুব বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন। তিনি শুধু শিমুল বাগান নয় পার্শ্ববর্তী টাঙ্গুয়া হাওরে লক্ষাধিক বিভিন্ন ধরনের গাছ রোপন করে গেছেন। যা এখন দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা দেখতে আসেন।
তিনি বলেন, সরকার যদি রাস্তাঘাট একটু উন্নয়ন করেন তাহলে এসব পর্যটন স্পটে আরো পর্যটকের সমাগম ঘটবে।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত