চট্টগ্রামে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। প্রতিদিনই নতুন নতুন নাম যোগ হচ্ছে এই মৃত্যুর মিছিলে। ভারি হচ্ছে চট্টগ্রামের বাতাস। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগের ভূমিকা। বেপরোয়া মনোভাব দেখাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। বাড়ছে ক্ষোভ, দাঁনা বাঁধছে জনরোষ।
গতকাল বুধবার (১০ জুন) রাত থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে, আইসিইউ-অক্সিজেনের অভাবে অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ চারজনের মৃত্যু হয়। অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বামী চিকিৎসকের পায়ে ধরেও তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার মুক্তার (৩০) জন্য আইসিইউ’র ব্যবস্থা করতে পারেননি। চারটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও এতটুকু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা যায়নি নগর বিএনপির নগর বিএনপির সহসভাপতি লায়ন মো. কামাল উদ্দিনের জন্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (চবিসাস) সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের চৌধুরীর বাবাকে ন্যাশনাল হাসপাতালে দেয়া যায়নি অক্সিজেন সাপোর্ট। তিনটি হাসপাতালে নিয়েও অসুস্থ বাবা প্রীতি বিকাশ দত্তকে অক্সিজেন সেবা দিতে পারেননি পুত্র অভিজিৎ দত্ত। এ নিয়ে দায়িত্বশীল সংস্থা কিংবা জনপ্রতিনিধি কারও মধ্যেই কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
নগরবাসীর প্রশ্ন, চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আর কত লাশ দরকার। কত মৃত্যুর বিনিময়ে তাদের হাসপাতালের দ্বার খোলা হবে। বৈশ্বিক মহামারির এমন স্পর্শকাতর কঠিন মুহূর্তে চট্টগ্রামের প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, জনপ্রতিনিধি নীরব কেন। কখন তাদের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিতে গঠিত সার্ভিল্যান্স টিমের আহ্বায়ক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিদিনই বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার খবর আসছে। এটি অবশ্যই দুখজনক। গতকাল বিকাল থেকে হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে। এখন আর কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, হাসপাতালগুলো আমরা প্রতিনিয়তই মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখছি। এরপরও রোগী ভর্তি না করানোর অভিযোগ আসছে। এখন অভিযান শুরু হয়েছে। প্রতিদিন চলবে অভিযান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট এলাকার বাসিন্দা দুই সন্তানের জননী ফাতেমা আক্তার মুক্তাকে (৩০) গত বুধবার প্রথমে মা ও শিশু হাসপাতল, সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অক্সিজেন সাপোর্ট পেলেও দরকার হয় আইসিইউ।
মৃতের স্বামী তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, গতকাল বুধবার সকালে মা ও শিশু হাসপাতালে গেলে বিভিন্ন টেস্ট করিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত ছিলাম। বিকালে স্ত্রীর জন্য আইসিইউ দরকার হলে চিকিৎসকের পায়ে ধরে বলেছি এক ঘণ্টার জন্য হলেও আইসিইউ দেন। অবস্থা স্থিতিশীল হলে ছেড়ে দেবো। কিন্তু পাওয়া যায়নি। পরে চমেক হাসপাতালে গেলাম। সেখানে অক্সিজেন পাওয়া গেলেও অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা আইসিইউ’র কথা বলেন। বুধবার রাত পৌনে চারটার দিকে আমার স্ত্রী মারা যান। পত্রিকায় হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়ার সংবাদ পড়েছি, আজ নিজেই এর স্বাক্ষী হলাম।
অন্যদিকে, নগর বিএনপির সহ-সভাপতি লায়ন মো. কামাল উদ্দিনের গতকাল বুধবার রাতে শ্বাসকষ্টে বেড়ে যাওয়ায় প্রথমে মা ও শিশু হাসপাতাল, সেখানে অক্সিজেন না পাওয়ায় পার্কভিউ, ম্যাক্স ও মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেয়া হয়। করোনা সন্দেহে ভর্তি নেয়নি কোথাও। পরে ট্রিটমেন্ট হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান তিনি।
নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, কামাল উদ্দিনের করোনার উপসর্গ ছিল। শ্বাসকষ্টে বেড়ে যাওয়ায় চারটি হাসপাতালে নেওয়ার পরও ভর্তি করা হয়নি। পরে ট্রিটমেন্ট হাসপাতালে আনার পর তার অক্সিজেন নেমে গিয়েছিলো ৭৮-এ। তখন তার আইসিইউ সাপোর্ট লাগতো। এখানকার তিনটি আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। এরপর তিনি মারা যান।
এদিকে, চবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের চৌধুরীর বাবা মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরীকে গতকাল বুধবার রাতে নেয়া হয় ন্যাশনাল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে তাকে শয্যা খালি নেই বলে ভর্তি নেয়নি। জরুরি বিভাগে একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে বলা হলেও তা করা হয়নি। পরে তাকে নেয়া হয় চমেক হাসপাতালে। রাত সাড়ে ৩টায় তিনি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মারা যান।
অন্যদিকে, গতকাল বুধবার রাত সাড়ে আটটায় নগরের দক্ষিণ নালাপাডা প্রীতি বিকাশ দত্তের বুকে ব্যাথা উঠলে ছেলে অভিজিৎ দত্ত বাবাকে নিয়ে যান মা-মনি হাসপাতাল, ম্যাক্স, ন্যাশনাল হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও মিলেনি চিকিৎসা। পরে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া পরই তিনি মারা যান।
অভিজিতের বন্ধু বিজয় বলেন, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তিনটি হাসপাতালে ঘুরেও করোনা সন্দেহে কোনো হাসপাতাল ভর্তি করা হয়নি। পরে চমেক হাসপাতালের নিয়ে যাওয়ার পর তিনি মারা যান।
বিডি-প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ