চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। মাত্র তিন বছর আগেও ছিল আর্থিক দৈন্যদশা। পশু থাকত অনাহারে। অনেক প্রাণীর খাঁচা থাকলেও তা জীর্ণশীর্ণ। ফলে দর্শক শূন্যতা ছিল প্রকট। কিন্তু এখন পরিবর্তন এসেছে চট্টগ্রামের একমাত্র এ চিড়িয়াখানায়। প্রতিদিন গড়ে দর্শনার্থী প্রবেশ করছে তিন হাজার। ছুটির দিনে তা বেড়ে হয় সাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার পর্যন্ত।
শুক্রবার ছুটির দিনে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থী ছিল সাত হাজার ৪৫ জন। ফলে ঘুচছে আর্থিক দৈন্যতা। ২০১৫-২০১৭ পর্যন্ত তিন বছরে টিকিট বিক্রির অর্থ দিয়েই করা হয়েছে আড়াই কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ। যোগ হয়েছে দু’টি বাঘ ও একটি সিংহ। ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে আগামী মাসে আসছে ছয়টি জেব্রা।
অভিযোগ আছে, অতীতে চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে ছিল দুর্গন্ধ। জরাজীর্ণ-বিবর্ণ প্রাণীর খাঁচা। বাঘের খাঁচায় রাখা হত তিতিরপাখি। সিংহের খাঁচা ছিল সিংহ শূন্য। ভাঙা খাঁচা থেকে হনুমান ও বানর বের হয়ে লাফালাফি করত। ছিল না কোনো সীমানা প্রাচীর। ২৫ বছর ধরেই মিটিংয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। দক্ষিণ পাশে ছিল বর্জ্যরে ভাগাড়। চিড়িয়াখানার পেছনে ছিল অনেকগুলো ছোটছোট ঝুপড়ি ঘর। প্রতিটি ঘরে ছিল ফ্যান আর একটি খাট। ভেতরের সড়কগুলোর অবস্থা ছিল বেহাল। প্রাণীদের জন্য ছিল না পানির স্থায়ী ব্যবস্থা। কাগজে-কলমে প্রাণীকে গরুর মাংস খাওয়ানোর কথা উল্লেখ থাকলেও খাওয়ানো হতো মুরগির মাংস। এমনকি ক্রয়কৃত খাবারের একটা অংশ কেয়ারটেকাররা তাদের নিজ বাড়ির গরু ছাগলকেও দেওয়া হতো। আয়ের একমাত্র উৎস টিকিট বিক্রির কোনো হিসাব ছিল না।
চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মুহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা আর শুদ্ধাচারের অনুশীলন থাকলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবেই। আমি মনে করি এই শুদ্ধচারের উত্তম দৃষ্টান্ত চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার সময় একাউন্টে ছিল এক লাখ ৭৬ হাজার ১২০ টাকা। এখন আড়াই কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ, ৩৩ লাখ টাকায় দুটি বাঘ, ৪৮ লাখ টাকায় ৬টি জেব্রা ক্রয়ের পরও ব্যাংকে এখন জমা আছে ৬০ লাখ টাকা এবং চিড়িয়াখানার নামে এফডিআর করা আছে এক কোটি সত্তর লাখ টাকার। সব কাজই করা হয়েছে কেবল টিকিট বিক্রির অর্থ দিয়ে। শুদ্ধাচারের চর্চা আছেই বলে এটি সম্ভব হয়েছে।’
জানা যায়, বর্তমানে পরিবর্তন আসছে চিড়িয়াখানায়। টিকিট বিক্রির ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় সীমানা প্রাচীর, পশুদের জন্য দেওয়া হয় খাঁচা, আবর্জনার ভাগাড়কে করা হয়েছে নান্দনিক বৈঠকখানা। তিতিরপাখিকে দেওয়া হয়েছে পৃথক ঘর। বানানো হয়েছে সিঁড়ি। ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে প্রধান ফটক। চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়ে ৩২ হাজার ১৬৪ বর্গফুট রাস্তা। পুরো চিড়িয়াখানা আনা হয়েছে সিসি ক্যামেরার আওতায়। বাচ্চাদের জন্য করা হয়েছে ‘কিডস জোন’। পানির চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছে দীর্ঘ ড্রেইন। পশুর সুরক্ষায় নির্মিত হয়েছে নিরাপত্তা দেয়াল। দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার। চিড়িয়াখানার তাপমাত্রা সঠিক রাখতে লাগানো হয়েছে এক হাজার ফলজ বৃক্ষ। প্রাণীখাদ্য সংরক্ষণে নির্মাণ করা হয়েছে স্টোর রুম, কোয়ারেন্টাইন রুম এবং অপারেশন থিয়েটারসহ আধুনিক প্রাণী হাসপাতাল।
চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান সাধারণ মানুষের বিনোদন, শিশুদের শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য নগরের খুলশিস্থ ফয়েজ লেকের পাশে ৬ একর জমির উপর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সেখানে ৬৭ প্রজাতির তিন শতাধিক পশু-পাখি আছে। শুরুতে চিড়িয়াখানায় প্রবেশমূল্য ছিল এক টাকা। পরে মূল্য বৃদ্ধি করে প্রথমে ২ টাকা থেকে পর্যায়ক্রমে ৩ টাকা, ৪ টাকা এবং ৫ টাকা করা হয়। ২০০৪ সালে ১০ টাকা, ২০১০ সালে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন