টানা ২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষে সরগরম দক্ষিণের সর্ববৃহৎ বরিশালের পোর্টরোড ইলিশ মোকাম। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ১৬ ঘণ্টার মধ্যে ৩ হাজার মণেরও বেশি ইলিশ এসেছে এই আড়তে। তবে আড়তে আসা বেশিরভাগ ইলিশের পেটেই ডিম। নিষেধাজ্ঞার সময় আরও কয়েকদিন পিছিয়ে দিলে জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশ নদী কিংবা সাগরে ডিম ছাড়ার সুযোগ পেতে বলে মনে করেন মৎস্যজীবীরা।
এদিকে, সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বরিশালের পাইকারি মোকামে বৃহস্পতিবার প্রথম দিনে পানির দরে বিক্রি হয়েছে রূপালি ইলিশ। কেজি সাইজের একমণ ইলিশ বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার টাকায়। গত দেড় বছরের মধ্যে এত কম দামে ইলিশ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য আড়তদার এসোসিয়েশেনের সাধারন সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল। তবে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডিমওয়ালা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করতে যথা সময়েই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিলো বলে জানিয়েছেন বরিশালের ইলিশ বিশেষজ্ঞ ড. বিমল চন্দ্র দাস।
নদ-নদী-সাগরে সারা বছরই ডিম ছাড়ে ইলিশ। তবে আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে ও পরের সমটায় ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করে মৎস্য বিভাগ। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করতে সরকার দেশের ৭ হাজার কিলোমিটার জলসিমায় এবং সাগরে গত ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর মধ্য রাত পর্যন্ত সকল ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞাকালীন ফাঁক-ফোকর গলে অসাধু জেলেসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অভ্যন্তরীন নদ-নীতে কিছু মাছ শিকার করে। ২২দিনের নিষেধাজ্ঞাকালে মৎস্য বিভাগ ৮৫২টি অভিযান চালিয়ে ৬.০২৯ মেট্রিক টন ইলিশ এবং ২৩.২৭৩ লাখ মিটার কারেন্ট জালসহ ৫৩৩ জন আটক করে। এই সময়ে ২৬১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৭৯৫টি মামলা দায়েরসহ ৫৩৩জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ ৩শ’৭৫ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
মৎস্য বিভাগের দাবি নিষেধাজ্ঞা সফল হয়েছে বলেই প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে নদ-নদীতে।
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ৬ ঘণ্টার মধ্যেই বৃহস্পতিবার সকালে বরিশাল পোর্ট রোড ইলিশ মোকামে গিয়ে দেখা যায়, ইলিশ বোঝাই ট্রলারের পর ট্রলার এসে ভিড়ছে পোর্টরোড ঘাটে। শ্রমিকরা ঝুঁড়ি ও সাঁজি ভরা ইলিশ উঠাচ্ছেন আড়তে। সেখানে প্রকাশ্য ডাক হেকে বিক্রি হচ্ছে ইলিশের লট।
বৃহস্পতিবার প্রথম দিন ১২০০ গ্রামের বেশি সাইজের প্রতিমণ ইলিশ ৩২ হাজার, কেজি সাইজের প্রতিমন ২৮ হাজার, এলসি সাইজ (৬শ’ থেকে ৯শ’ গ্রাম) ২৩ হাজার এবং ৪শ’ থেকে ৬শ’ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ পাইকারি বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার টাকায়।
জেলা মৎস্য আড়তদার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর প্রথম দিন সরবরাহ বেশি থাকায় দাম ছিল কম। আগামী দিনগুলোতে সরবরাহ বেশি থাকলে দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে আর সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার সকালে পোর্টরোড মোকামে গিয়ে ২৩ হাজার টাকা মণ দরে এলসি সাইজের ২০ কেজি ইলিশ কিনেছেন ৪ বন্ধু। পরে তারা সমান ভাগ করে নেন। তাদের একজন সুমন চৌধুরী বলেন, অন্যান্য সময়ের চেয়ে ২ থেকে ৩শ’ টাকা কমে প্রতি কেজি ইলিশ কিনেছেন তারা। এই দামে বরিশালের বাজারে কেউ ইলিশ কিনতে পারেনি বলে তিনি জানান। তুলনামূলক কম দামে ইলিশ কিনতে পেরে দারুণখুশি সুমন ও তার ৩ বন্ধু।
অফিসের কাজে বৃহস্পতিবার সকালে পোর্টরোড মোকামে গিয়ে ইলিশের কম অনেক দাম দেখে ৮ কেজি ইলিশ কেনেন সাংবাদিক গিয়াস উদ্দিন সুমন। ২টি ইলিশে ৩ কেজির দাম পড়েছে ২ হাজার ২শ’ ৫০ টাকা এবং এলসি সাইজের ৫ কেজির দাম পড়েছে ৫৮০ টাকা করে। ২ হাজার ৯শ’ টাকা।
গিয়াস উদ্দিন সুমন বলেন, ইলিশের দাম অনেক কম। এত কম দামে ইলিশ বরিশালের বাজারে কল্পনাই করা যায় না।
ইলিশের দাম কমে যাওয়ার খবরে পোর্টরোড বাজারে গিয়ে ৩শ’ টাকা কেজি দরে অর্ধ কেজি ইলিশ কিনেছেন রিকশাচালক সগির মিয়া। তিনি বলেন, বছরের অন্যান্য সময় ইলিশের দাম থাকে তাদের নাগালের বাইরে। তাই সাধ ধাকলেও তাদের ইলিশ খাওয়ার সাধ্য থাকে না। এখন কম দামে ইলিশ কিনে দারুণ খুশি তিনি।
সুমন, গিয়াস ও সগির মিয়ার মতো অনেক মানুষ বৃহস্পতিবার দিনভর সাধ্য মতো ইলিশ কিনেছেন পোর্টরোড মোকামে গিয়ে।
পোর্ট রোডে শুধু স্থানীয়রাই ইলিশ কেনেননি। প্রচুর সরবরাহ থাকায় পাইকরাও ঝুঁড়িতে বরফজাত করে সাইজি পাঠিয়েছেন ঢাকা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, বেনাপোল, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
পোর্টরোডের আড়তদার জহির সিকদার জানান, আড়তে আসা ইলিশের বেশিরভাগের পেটেই রয়েছে ডিম। ৯ থেকে ৩০ অক্টোবরের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কয়েকদিন পিছিয়ে দিলে বেশিরভাগ ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ার সুযোগ পেত। মৎস্য বিভাগ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে অনুযায়ী ইলিশ প্রজননে সুফল পাওয়া গেলো না।
মৎস্য আড়তার এসোশিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল বলেন, এবারের নিষেধাজ্ঞা ৭০ ভাগ সফল হয়েছে। তাদের মতামত গুরুত্ব দিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরও কয়েকদিন পিছিয়ে দিলে শতভাগ সাফল্য পেতো মৎস্য বিভাগ।
বরিশাল জেলা মৎস্য দপ্তরের কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, সারা বছরই ইলিশের প্রজনন হয়। আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে পরের মোট ২২দিন ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এই সময়ে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করে মৎস্য বিভাগ সফল। এ কারণে নদীতে এত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। সামুদ্রিক ইলিশ এলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাবে এবং তখনও দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে থাকবে বলে আশা করেন তিনি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন