আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইয়ের একটি হাসপাতালের মর্গে প্রায় এক মাস ধরে পড়ে ছিল নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা প্রবাসী মনির হোসেনের (৪৫) মরদেহ। একে তো স্বামী হারানোর শোক তার উপর অর্থের অভাবে স্বামীর মরদেহ আনতে পারছিলেন না মনির হোসেনের স্ত্রী ঝর্না বেগম। মরদেহ দেশে আনতে স্বামীকে এক নজর দেখতে অনেকের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পেতেছিলেন। উপায় না পেয়ে শেষ বারের মতো দেখার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন স্ত্রী ঝর্না।
দুবাইয়ের মাটিতেই স্বামীকে দাফন করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ পরিষদকে সিদ্ধান্ত জানিয়েও দিয়েছিলেন। তবে স্বামীকে এক নজর দেখার আশা শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়েছে ঝর্নার।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, তার স্ত্রী সালমা ওসমান লিপি ও শ্যালক তানভীর আহাম্মেদ টিটুর আর্থিক সহযোগিতায় দীর্ঘ ২৮ দিন পর দেশে ফিরেছে প্রবাসী মনির হোসেনের মরদেহ।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটি হরিহরপড়া এলাকায় মা, স্ত্রী, এক কন্যা সন্তান ও এক বোনকে নিয়ে ছিল সিএনজি চালক মো. মনির হোসেন (৪৫) সংসার। বোনকে বিয়ে দিলেও খোঁজ-খবর রাখতেন। মা মারা যান ২০১২ সালে । তার কিছু দিন পরই মারা যান এক মাত্র বোনও। মা ও বোনকে হারানোর শোক ও অর্থের কষ্ট দূর করে ভাগ্য বদলের আশায় প্রবাসে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখতে থাকেন মনির।
নারায়ণগঞ্জে স্ত্রী ঝর্ণা বেগম, এক মাত্র মেয়ে মিম আক্তারকে দেশে রেখে ২০১৭ সালে দুবাই চলে যান। প্রথমে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করলেও পরে মাত্র ২০ হাজার টাকা বেতনে একটি দোকানে কাজ করতেন মনির হোসেন। অল্প এই আয় থেকেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, স্ত্রী থাকতেন পঞ্চবটির সামসুল হক চেয়ারম্যানের ভাড়া বাসায়। নিজেদের এক খণ্ড জমি হবে, বাড়ি মালিক হবেন; এমন স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না মনিরের।
গত ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টার দিকে স্ত্রী ঝর্না বেগমের সঙ্গে শেষ বারের মতো কথা হয়েছিল প্রবাসী মনির হোসেনের। ফোন রাখার বেশ কিছুক্ষণ পরে আবারও মনিরের নম্বর থেকে ফোন আসে ঝর্না বেগমের মোবাইলে। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে অপরিচিত ব্যক্তির কণ্ঠ। ওই কণ্ঠের বার্তায় পৃথিবী থমকে যায় ঝর্না বেগমের। দম যেন আটকে আসে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না ঝর্নার। ঝর্নার সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে মনির হোসেনের।’
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অকাল প্রয়াণের শোকে কাতর হলেও কয়েকদিনের মধ্যে নিজেকে সামলে নেন ঝর্না বেগম। চেষ্টা করতে থাকেন স্বামীর মরদেহ দেশে ফেরত আনার। একটি একটি করে দিন চলে যায়। করোনাকালে বিমানের ভাড়া বৃদ্ধি, তার সঙ্গে নানা আইনি জটিলতায় আটকে যায় শেষ বারের মতো বিদায় জানানোর আকাঙ্খা। স্বামীকে শেষ বারের মতো দেখতে তার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টার কোনো কমতি করেননি ঝর্না বেগম। সেই স্বামীকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় দিনানিপাত করছিলেন এই নারী। তবে কোনো দিকেই কোন কুলকিনারা হচ্ছিল না। আশা ছেড়ে দিয়ে ২৫ দিন হিমাগারে মরদেহ থাকার পর ওখানেই দাফনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন ঝর্না বেগম।
এরমধ্যেই গত ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান স্বপরিবারে দুবাই যান। এ সময় সাথে ছিলেন তার শ্যালক নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি তানভির আহম্মেদ টিটু। মৃত মনিরের মরদেহ দেশে পাঠানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন দুবাইয়ের ‘নারায়ণগঞ্জ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদ’। সংগঠনটির সভাপতি মোক্তার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল্লাহ রাজুর মাধ্যমে তানভির আহম্মেদ টিটু মনিরের পুরো বিষয়টি জানতে পারেন। কান্না শোনে মনিরের পরিবারের সদস্যদের। ‘আইনি জটিলতার পাশাপাশি অর্থ সংকটের জন্য মরদেহ দেশে পাঠানো যাচ্ছে না’ বিষয়টি দ্রুত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানকে জানান টিটু।
বিদেশের মাটিতে নারায়ণগঞ্জের সন্তানের শেষ বিদায়ের পরিণতি সালমা ওসমান লিপির (শামীম ওসমানের স্ত্রী) হৃদয়ে কষ্টের চাপ বাড়ে। শামীম ওসমান, সালমা ওসমান লিপি ও তানভির আহম্মেদ টিটু ৩ জনের সহযোগিতায় প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে মরদেহটি দেশে পাঠানো ব্যবস্থা করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর রাতে মনিরের মরদেহ দুবাই থেকে একটি বিমানে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে মনিরের পরিবারে কাছে মরদেহটি এসে পৌঁছায়।
দীর্ঘ ২৮ দিন পর স্ত্রী-কন্যার কাছে ফিরেছে মনির। হয়তো বলবে না কথা, চোখ খুলে তাকাবে না আর, তবুও শেষ বারের মতো বিদায় দিতে পারছে; আপন জন হারানোর কঠিন শোকের মাঝেও যেন আকাঙ্খা পূরণের পরম শান্তি পাচ্ছেন মেয়ে মিম আক্তার ও স্ত্রী ঝর্না বেগম।
দুবাই থেকে তানভির আহম্মেদ টিটু জানান, দুবাইয়ে প্রবাসীদের নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করে ‘নারায়ণগঞ্জ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদ’। আমি দুবাই আসার পর পরই (১২ ডিসেম্বর) তারা আমাকে জানান, ‘নারায়ণগঞ্জের একজনের মরদেহ অনেক দিন ধরে এখানকার একটি মর্গে পরে আছে। অর্থের অভাবে দেশে পাঠানো যাচ্ছে না’। আমি শামীম ভাই ও লিপি আপার সঙ্গে আলাপ করি। পুরো ব্যয়টা আমরা তিন জনেই ব্যবস্থা করি। ‘নারায়ণগঞ্জ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদ তাদের সহযোগিতা ও বাংলাদেশি কনস্যুলেটের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পাঠানো হয়েছে।
প্রয়াত প্রবাসী মনির হোসেনের মেয়ে মিম আক্তার বলেন, ‘১৮ নভেম্বরের পর থেকে প্রতিটি দিন আমাদের কাছে যুগ যুগ মনে হয়েছে। যাকেই সামনে পেয়েছি, তার কাছেই সাহায্য চেয়েছি। অনেকে চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু আমার বাবাকে দেশে আনতে পারছিলাম না। তাই দুবাইয়ের মর্গেই দীর্ঘদিন পড়েছিল বাবার মরদেহ। শেষ দেখা দেখতে না পারার সীমাহীন কষ্ট নিয়েই আবেদন করেছিলাম সেখানে (দুবাই) দাফন করতে। কিন্তু তাতেও সৃষ্টি হয়েছিল আইনি জটিলতা।
১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মনির হোসেনের মেয়ের জামাতা প্রবাসী মাসুদ হোসেন বলেন, শামীম ওসমান ও তার পরিবারের একান্ত সহযোগিতায় আমার শ্বশুরের মরদেহ দেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। প্রবাসীদের অংশগ্রহণে দুবাইয়ে জানাজা হয়েছে।
১৭ ডিসেম্বর রাতে পঞ্চটিতে মনিরের মরদেহ এসে পৌঁছালে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে রাতে মাসদাইর কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়।
দুবাই হতে বাংলাদেশে মরদেহ পাঠানোর আর্থিক ব্যবস্থাসহ সকল সহযোগিতা করা এমপি শামীম ওসমান, তার পত্মী সালমা ওসমান লিপি ও তানভির আহম্মেদ টিটুও ১৭ ডিসেম্বর দেশে ফিরেন। পরে সন্ধ্যায় শামীম ওসমানের পক্ষ থেকে তানভির আহম্মেদ টিটু ছুটে যান নিহত পরিবারের পাশে। শান্ত্বনা দেন, জানান সমবেদনা। উপস্থিত থাকে জানাজা নামাজেও।
মনির হোসেনের স্ত্রী ঝর্না বেগম বলেন, ‘আমার জীবনের অনেক বড় ইচ্ছে পূরণ করেছেন শামীম ওসমান-সালমা ওসমান লিপি ও তানভির আহম্মেদ টিটু ভাই। আমরা তাদের এই ঋণ কখনো পরিশোধ করতে পারবো না। শুধু দোয়া করতে পারবো, আল্লাহ যেন ওনাদের মনের ইচ্ছাও পূরণ করেন’।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন