বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা
বনানীর বদলে পল্লী নিবাস

এরশাদের সমাধির ১৯২ ঘণ্টার গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে লাখো জনতার অংশগ্রহণে রংপুরের পল্লী নিবাসেই সমাহিত হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গত ৮ জুলাই প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে জনসমুখে এই দাবি এনেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এই দাবি আদায়ে রয়েছে মোস্তফা এবং উত্তরাঞ্চল জাতীয় পার্টি নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের ১৯২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর গল্প। ৮ জুলাই দুপুর। ঝিরিঝিরি              বৃষ্টি পড়ছিল তখন। রংপুর সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে নামতেই এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আবদুুর রাজ্জাকের। তিনি জরুরি মিটিং আছে বলে মেয়র মোস্তফার রুমে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ১৫ মিনিটের জন্য একটি জরুরি বৈঠক হলো। প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফার সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি আজমল হোসেন লেবু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আবদুর রাজ্জাক ও শাফিউল ইসলাম শাফি, মহানগর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুজ্জামান নাজিম, জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আবদুুল বারীসহ জেলা ও মহানগরের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। মোস্তফার কাছে ওপরের নেতারা তাদের দাবি জানিয়ে যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য দেন। মোস্তফাও একমত পোষণ করে ওই বৈঠকে জরুরি ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে রংপুর বিভাগ, জেলা ও মহানগর নেতাদের সম্মতি নিয়ে সেন্ট্রাল রোডের পার্টি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মোস্তফা ঘোষণা দেন, ‘প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মে তিনি পৃথিবী থেকে চলে গেলে আমাদের রাজনৈতিক পিতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপি মহোদয়কে তাঁর ওছিয়তকৃত স্থান পল্লী নিবাসেই করতে হবে।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকায় খোলা স্পেসে তাঁকে সমাহিত করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমরা এরশাদের দেওয়া জাতীয় তিন নেতার মাজারের পাশে অথবা সংসদ ভবনের পাশে আসাদ গেট এলাকায় মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কবরের পাশে জায়গার জন্য সরকারকে বলেছি। কিন্তু সে ব্যাপারে আমাদের কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি। মোহাম্মদপুর কবরস্থানে সেই এলাকার মেয়র মাত্র একটি কবরের জায়গা দেওয়ার জন্য রাজি হয়েছেন। এরশাদকে সেখানে সমাহিত করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ক্যান্টনমেন্টে এরশাদকে সমাহিত করা হলে আমরা জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা তার কবরও জেয়ারত করতে পারব না। সে কারণে তার সমাধি রংপুরের মাটিতে তার নিজের গড়া পল্লী নিবাসেই দিতে হবে। অন্য কোথাও আমরা মানব না। অন্য কোথাও দেওয়ার চিন্তা করা হলে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিহত করা হবে।’

১৪ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় এরশাদ মারা যাওয়ার খবর ব্রেকিং নিউজের চাংকে স্থান পায়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে রংপুরের ওছিয়তকৃত পল্লী নিবাসে সমাহিত করার দাবি একদফাতে পরিণত হয়। সন্ধ্যায় আবারও সংবাদ সম্মেলন করে সিটি মেয়র মোস্তফা ঘোষণা দেন, রক্তের বিনিময়ে হলেও স্যারের সমাধি তার ওছিয়তকৃত পল্লী নিবাসে দিতে হবে। সেদিন ঢাকা থেকে আসা মহানগর সেক্রেটারি এস এম ইয়াসিরও উপস্থিত হন সংবাদ সম্মেলনে। দাবি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি লাশ রংপুরে জানাজা ও দাফনের প্রস্তুতিও চলতে থাকে। পরের দিন সোমবার (১৫ জুলাই) দলীয় কার্যালয়ে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগীয় নেতাদের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সর্বসম্মতিক্রমে আবারও এরশাদকে পল্লী নিবাসে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়।

লাখো আবালবৃদ্ধবনিতার নজিরবিহীন বিক্ষোভের মুখে অবশেষে ওছিয়তকৃত পল্লী নিবাসের লিচুবাগানেই সমাহিত হলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট দেশ-বিদেশে বহুল পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রওশন এরশাদ, জি এম কাদেরসহ পার্টির নীতিনির্ধারকদের ঢাকায় বনানী কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। বিকাল ৫টা ৪৩ মিনিটে সেনাবাহিনীর তত্ত্ব¡াবধায়নে সামরিক মর্যাদায় লাখো জনতা তাঁকে সমাহিত করেন।

গত ২৬ জুন জ্ঞান হারিয়ে রাজধানীর সিএমএইচে ভর্তি ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৪ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রতিটি জনপদ।

 

 

সর্বশেষ খবর