শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ডায়াবেটিস রোগীরা

চার প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণা

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ডায়াবেটিস রোগীরা

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের পর সুস্থদের মধ্যে ৭৫ ভাগ ডায়াবেটিস রোগী কোনো না কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগছেন। তাছাড়া করোনায় আক্রান্তদের প্রতি পাঁচজনে একজন ডায়াবেটিস রোগী। এর মধ্যে পুরুষ এবং ৩১-৫০ বছরের ডায়াবেটিস রোগীরা সবচেয়ে বেশি শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। করোনা পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি নানা জটিলতা দেখা যায় ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীদের মধ্যে। আক্রান্ত প্রতি ১০০ জনের মধ্যে একজন সুস্থ হওয়ার পর নতুনভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম বিশ্বিদ্যালয় (চবি), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক), চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল ইনফেকসাস ডিজিজের (বিআইটিআইডি) যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য ওঠে আসে। গবেষণা পত্রে দেখা যায়, করোনায় আক্রান্ত ৪০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগীকেই ইনসুলিনের মাত্রা তিনগুণ করতে হয় রক্তে শ্র্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য। আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের ৯০ ভাগেরই জ্বর, ৬০  ভাগের কফ ও কাশি এবং ৪৫ ভাগের শারীরিক ব্যথা লক্ষ্য করা যায়। ৬০ ভাগের বেশি রোগীর ফেরিটিন ও ডি ডাইমারের পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে উপসর্গবিহীন হওয়ার সংখ্যা কম। মাত্র ৪ ভাগ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কোনো উপসর্গ পর্যবেক্ষিত হয়নি। কিন্তু ডায়াবেটিসবিহীন করোনা রোগীদের মধ্যে বেশি  উপসর্গবিহীন হওয়ার মাত্রা দেখা গেছে। গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী ড. আদনান মান্নান বলেন, ‘যাদের দীর্ঘ মেয়াদি শারীরিক সমস্যা আছে, করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের বিভিন্ন উপসর্গ ও সমস্যা দেখা যায়। এটি ইতিমধ্যে বিশ স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এক কোটি ডায়াবেটিস রোগী থাকার কারণে তাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া আলাদাভাবে জানা প্রয়োজন। কারণ ডায়াবেটিস বহুমাত্রিক শারীরিক সমস্যা, যা অনেক উপসর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ করোনাভাইরাস একই সঙ্গে একজন রোগীর অনেক অঙ্গকে আক্রান্ত করার প্রবণতা দেখায়।’  গবেষণা দলের ক্লিনিক্যাল প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার বলেন, ‘বিশ্জুড়ে বিভিন্ন গবেষণায় করোনায় আক্রান্তদের বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। আমাদের গবেষণায়ও এর প্রতিফলিত ঘটেছে। ডায়াবেটিস রোগীর যে কোনো সংক্রমণ হলে স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়, যা রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে আক্রান্তদের এই স্ট্রেস হরমোনের কারণে ডায়াবেটিস মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। তাছাড়া করোনার চিকিৎসায় কিছু ওষুধ ব্যবহার করায় ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে বেশি সংক্রমণের কারণে ইনসুলিনও ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে রোগীর ইনসুলিন গ্রহণের মাত্রা বেড়ে যায়। তাছাড়া করোনা পরবর্তী নতুন ডায়াবেটিস রোগীও পাওয়া যায়, যাদের ব্যাপারে আরও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার পরিকল্পনা আছে।’ ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, ‘করোনা পরবর্তীতে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ৪৫ ভাগের প্রায় চার থেকে ছয় সপ্তাহ প্রচ- বা মাঝারিমানের শারীরিক ব্যথা অনুভব করেন। ৩০ ভাগ রোগীর রাতে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের শারীরিক জটিলতা দূর করতে করোনা পরবর্তী সময়ে হাঁটাচলা, শ্রীর চর্চা ও নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।’ গবেষণায় বলা হয়, আন্তর্জাতিকভাবেও ডায়াবেটিসকে করোনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশ্নের এক প্রতিবেদনে, যুক্তরাজ্যে করোনায় আক্রান্তদের মাঝে ২০ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্রে ১১ ভাগ এবং চীনে ১০ ভাগ রোগী ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে প্রতি দশ্জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দেশে বর্তমানে প্রায় এক কোটি ডায়াবেটিস রোগী। চট্টগ্রামে প্রায় দশ লাখের বেশি। পৃথিবীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ অষ্টম। ডায়াবেটিসের তীব্রতার কারণে করোনার সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক, প্রতিক্রিয়া, সুস্থ হতে জটিলতা ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা জরুরি। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশ্না সংস্থা এলসেভিয়ার-এর ‘ডায়াবেটিস অ্যান্ড মেটাবলিক সিনড্রোম : ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউস’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের চারটি কভিড হাসপাতালে গত এপ্রিল থেকে জুন মাসে ভর্তি রোগীর ওপর পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে গবেষণাটি তৈরি করা হয়।

 গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চমেকের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার ও চবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী ও ডা. আবদুর রব মাসুম, বিআইটিআইডির ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ এবং চবি  শিক্ষক মো. মাহবুব হাসান। তথ্য সংগ্রহে নেতৃত্ব দেন গবেষণা শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসেন মিয়াজি। গবেষণার তত্ত্বাবধান করে ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে করোনার তীব্রতা, উপসর্গ এবং করোনা পরবর্তী অবস্থা নিয়ে সম্পাদিত গবেষণায় করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার চার সপ্তাহ পর রোগীদের মাঝে পরিচালনা করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর