বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের পথে হাঁটছেন রাজশাহীর বোরহান বিশ্বাস রোমন। তার এমন পরিকল্পনা অনেকটাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো। কাঁটা তোলার মূল হাতিয়ার অ্যান্টিভেনম তৈরি নিয়ে আশাবাদী রোমন। তার মতে, সাপের কামড়ে আর একজন মানুষও যাতে না মরে সে লক্ষ্যে অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টা করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলে সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। এতে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। এ ছাড়া দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে অ্যান্টিভেনম। রাজশাহীর পবা উপজেলার ধর্মহাটা গ্রামে অ্যান্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যে বোরহান গড়ে তুলেছেন ‘সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণ কেন্দ্র’। তিনি ২০০৯ সালে কয়েকজন কর্মী নিয়ে এ কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে সাপের ডিম থেকে বাচ্চাও ফোটাতেন বোরহান। পরে বিভিন্ন কারণে সেখান থেকে সরে এসে এখন অ্যান্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যে গবেষণা চালাচ্ছে তার দল। তবে সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের সাপগুলো গবেষণার জন্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তারা জানান। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, সম্পূর্ণ আমদানিরনির্ভর অ্যান্টিভেনম দিয়ে চিকিৎসা চলে সাপে কাটা রোগীর। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে অ্যান্টিভেনম আমদানি করা হয়। সরকারিভাবে ছাড়াও দেশের ইনসেপটাসহ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি অ্যান্টিভেনম আমদানি করে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে যে অ্যান্টিভেনম আমদানি হয় তা ‘পলিভেনম’। অর্থাৎ গোখরা, কেউটে, রাসেল ফাইপারসহ পাঁচটি বিষধর সাপের বিষ দিয়ে তৈরি। কয়েকটি সাপের বিষে তৈরি হওয়ায় পলিভেনমটি এ দেশের সাপে কাটা রোগীর শরীরে আস্তে আস্তে কাজ করে। কারণ পাঁচ ধরনের সাপ থেকে নির্দিষ্ট মাত্রার বিষ দিয়ে তৈরি হয় এটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, বিষধর সাপ সব দেশে রয়েছে। তবে একেক দেশে একেক নামে পরিচিত। দেশের আবহাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বিষের টকসিন ভিন্ন মাত্রার হয়। ভারতের রাসেল ভাইপার সাপের বিষের সঙ্গে এ দেশের রাসেল ভাইপারের বিষ এক হবে না। হয় টকসিনের মাত্রা বেশি, না হয় কম হবে। তবে সুচিকিৎসার জন্য স্ব-স্ব দেশ বা অঞ্চলের সাপের বিষ দিয়ে তৈরি অ্যান্টিভেনম দ্রুত কাজ করে রোগীর শরীরে। তাই ভারতে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে অ্যান্টিভেনম তৈরির কথা ভাবছে ভারত সরকার। অর্থাৎ যে রাজ্যের সাপে কামড়াবে সে রাজ্যের ওই সাপের বিষ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনম রোগীর শরীরে দেওয়া হবে। এতে অল্প ডোজেই কাজ হবে। কমবে রোগী মৃত্যুর হারও। চিকিৎসকরা বলছেন, মূলত গোখরা (কোবরা) ও কেউটে (ক্রাইট) সাপের কামড়ে বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে কেউটে বাড়ির আশপাশে বা লাকড়ির (রান্নার খড়ি) মধ্যে থাকে। আর গোখরা ফসলি জমিতে ও রাস্তাঘাটে থাকে। গোখরা ও কেউটের বিষক্রিয়ায় পার্থক্য আছে। গোখরার কামড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়, চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আর কেউটের কামড়ে শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। পাশাপাশি কামড়ের স্থান ও দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের হয়। তবে বাংলাদেশে দুটি ক্ষেত্রেই একই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। পবার সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণ কেন্দ্রে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এখানে রয়েছে লেজার ব্ল্যাক রেইট, রাসেল ভাইপারসহ কয়েক প্রজাতির বিষধর সাপ। দুটি মৃত সাপকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে গবেষণার জন্য। সম্প্রতি যোগ হয়েছে বিরল রেড কোরাল কুকরি সাপটি। সে সাপটির জখমের স্থানে সেলাই দিয়েছেন বোরহান ও তার সহকর্মীরা।
বোরহান জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রকল্পে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভেনম রিসার্চ ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা যিনি জার্মানির একজন শিক্ষক তিনি তার সম্পর্কে জানতেন। তিনিই রোমনকে ভেনম রিসার্চ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষক হিসেবে নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। বোরহান আরও বলেন, সাপের অ্যান্টিভেনম ভারত থেকে আসে। অ্যান্টিভেনম দুই ধরনের আসে। একটি পলিভেলিন, অন্যটি মনভেলিন। তবে দেশে পলিভেলিন বেশি আসে। পলিভেলিন হচ্ছে কয়েকটি সাপের বিষ দিয়ে তৈরি একটি অ্যান্টিভেনম। আর মনভেলিন হচ্ছে একটি মাত্র সাপের বিষ দিয়ে তৈরি অ্যান্টিভেনম।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা অ্যান্টিভেনমগুলো আমাদের দেশের মানুষের শরীরে আস্তে আস্তে কাজ করে। এর বিকল্প উপায়ও নেই। আমাদের দেশে গ্রামের মানুষই সাপ দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। তারা হাসপাতাল থেকে অ্যান্টিভেনম গ্রহণ করে। হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম না পাওয়া গেলে বাইরে থেকে কিনতে হয়। এতে ১০ ভায়ালে এক ডোজ অ্যান্টিভেনমের দাম পড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা। অনেক সময় দেখা যায় একজন রোগীকে চার থেকে পাঁচ ডোজ অ্যান্টিভেনম নিতে হয় পুরোপুরি সুস্থ হতে। ফলে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে সাপে কাটা রোগের চিকিৎসা। সব থেকে ভালো হয় দেশে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা গেলে। এতে দেশের সাপ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনম দেশের মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহার হবে। ফলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ১০ ভায়ালের এক ডোজেই সুস্থ হবে রোগী।