রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়ানোর ব্যবস্থা না করায় চাপ পড়ে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তাই তিন দশকের বেশি সময় ধরে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। এ অঞ্চলে শস্য উৎপাদন বাড়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো ১৯৬২ সালে সরকারের কাছে সুপারিশ করে। ২০১৩ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব দাখিল করা হয়। অথচ আজ পর্যন্ত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষণ নেই। গত ও চলতি মাসেও প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় পৃথক মানববন্ধন হয়েছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ভূমি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেচের জন্য ১৯৮৫ সাল থেকে উঁচু বরেন্দ্রভূমিতে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি সেচকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের সাহায্যে বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে বিদ্যমান পানি সংকট নিরসন হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাব্বির সাত্তার তাপু ২০০২ সালে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার ভূমি জটিল হওয়ায় কেবল পর্যাপ্ত পানির অভাবে মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক গুণাবলি স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে থাকায় বৃক্ষ ও শস্যাদি ক্রমাগতভাবে পানি শোষণের ক্ষমতা হারাচ্ছে। তিনি সুরাপিশপত্রে এ অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা ও শস্য খেতে নিবিড় সেচ দেওয়ার লক্ষ্যে ভূ-উপরিস্থ পানির সংস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশও করেছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে তিন দশকের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের অন্যতম রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় পদ্মার তীরে পাম্প স্টেশনের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে তা নালার মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বরেন্দ্রভূমির শস্য খেতসহ গৃহস্থালির কাজে নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা সম্ভব।’
এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের ৭৪ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে নিবিড় সেচ দেওয়া যাবে। পাউবোর প্রকল্প নকশার সূত্র উল্লেখ করে জামাত খান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬২ সালে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারের কাছে সুপারিশ করে। প্রথমে রাজশাহী অঞ্চলের ১৫ উপজেলার ৬৭ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমি প্রকল্পাধীন বিবেচনা করা হলেও পরে বাস্তবতার নিরিখে তা বাড়িয়ে ৭৪ হাজার ৮৫০ হেক্টরে উন্নীত করা হয়।’
পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ১৯৮৮-৮৯ পর্যন্ত দুই বছর নিবিড় সমীক্ষা পরিচালনা করে। জাইকার প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে ৮৪৩ কোটি টাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়। এটি বাস্তবায়নে তিন বছর সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব দাখিল করা হয়। এরপর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারের সবুজ পাতায় ঠাঁই পায়। অথচ দীর্ঘ সময়েও বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই। এখন সেটি ব্যয় বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি সব সমীক্ষায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা অর্থমূল্যের আড়াই লাখ টন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদন হবে বলে আশা করা হয়েছে। ভূ-উপরিস্থ পানি সুলভ ও সহজ মূল্যে পেয়ে প্রকল্প এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ উপকৃত হতো এবং লক্ষাধিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে প্রকল্পটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে জাইকার ওই সমীক্ষায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা সমীক্ষাটি পরিচালনা করেন।’
প্রকল্প বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা তুলে ধরে রাজশাহী পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহীতে ভূ-উপরিস্থ পানি যেহেতু পর্যাপ্ত বিদ্যমান আছে, সেখানে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের প্রয়োজন নেই। উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব। এতে পানির স্তর নেমে যাওয়া রোধ করা যাবে।’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।