মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

অন্ধকারেই উত্তরের চার খনি

অদ্যাবধি উত্তোলন হয়নি লোহা তেল চীনামাটি চুনাপাথর ও কয়লা

নজরুল মৃধা, রংপুর

উত্তরাঞ্চলে চারটি খনি থেকে খনিজ দ্রব্য উত্তোলনে কার্যকর ব্যবস্থা অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি। ফলে এসব অমূল্য সম্পদ যুগ যুগ ধরে মাটির নিচেই রয়ে যাচ্ছে। এ খনিগুলোর মধ্যে রয়েছে রংপুরের পীরগঞ্জে আবিষ্কৃত দেশের একমাত্র লোহার খনি, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার শালবাহানের তেলকূপ, নওগাঁর চীনামাটি এবং জয়পুরহাটের জামালগঞ্জের চুনাপাথর ও কয়লাখনি। পীরগঞ্জের লোহার খনিটি সম্পর্কে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের পরপরই তৎকালীন পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগের বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যচিত্র অনুযায়ী বিমান ও গাড়ির বহর নিয়ে প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের খনির অবস্থান নিশ্চিত করতে অভিযান চালান। এ সময় তাঁরা হেলিকপ্টারের নিচে ঢেঁকির মতো শক্তিশালী চুম্বকদন্ড ঝুলিয়ে দিলে সেটি অনেক নিচু দিয়ে ওপরে উড়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে হেলিকপ্টারের ঝুলন্ত চুম্বকদন্ড ছোট পাহাড়পুর গ্রামের আবুল ফজল ও আবদুছ ছাত্তারের মালিকানাধীন জমির ওপর এসে আকর্ষিত হয়। সেখানে হেলিকপ্টারটিকে বারবার মাটির দিকে টেনে নিচে নামাতে চেষ্টা করে। এ ছাড়া অন্যান্য পরীক্ষার পর পাকিস্তানের খনিজ বিজ্ঞানীরা এখানে লোহার খনির উৎস হিসেবে নিশ্চিত হন এবং ওই জমির ওপর কংক্রিটের ঢালাই করা চিহ্ন দিয়ে প্রাথমিক জরিপকাজ সম্পন্ন করে চলে যান। প্রথম জরিপ সম্পন্নের পরের বছর পাকিস্তান খনিজ বিভাগের লোকজন এসে চিহ্নিত স্থানে খননকাজ শুরু করেন। ওই বছরই তারা কয়েক মাস ধরে তেলমারী পাথারের ৩ কিলোমিটার দূরে কেশবপুর ও ছোট পাহারপুর, প্রথম ভাজা গ্রাম, পবনপাড়া সদরা কুতুবপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় অসংখ্য স্থানে পাইপ বসিয়ে লোহার খনির সন্ধান নিশ্চিত করেন। এ সময় অনুসন্ধানের কাজে পাইপের ভিতর দিয়ে মাটির গভীরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পরে ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে একদল বিদেশি খনিজ বিশেষজ্ঞসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বিশাল বহর পানবাজার হাইস্কুল মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর তারা তেলমারী পাথারের বিভিন্ন স্থানে পাইপের মাধ্যমে সন্ধানপ্রাপ্ত লোহার উপাদান উত্তোলন করেন। এ সময় খনি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন এখান থেকে আহরিত লোহা উৎকৃষ্টমানের। সে সময় খনি সন্ধান উপলক্ষে এ এলাকায় কয়েক মাস ধরে মেলা বসে। যা খনি মেলা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। খনি কর্মকর্তারা সে সময় এলাকাবাসীকে জানিয়েছিলেন, মাটির ৯০০ ফুট নিচ থেকে ২২ হাজার ফুট পর্যন্ত পাইপ খনন করে তাঁরা লোহার উন্নত স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। এর বিস্তৃতি প্রায় ১০ কিলোমিটার। প্রায় এক বছরের বেশি অনুসন্ধান শেষে ভেলামারীতে স্থাপিত চারটি মূল পাইপের উৎসমুখ কংক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে বন্ধ করে তাঁরা ক্যাম্প গুটিয়ে চলে যান। এর ৩৪ বছর পর ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সরকার পুনরায় অনুসন্ধান কাজ শুরু করে। কিন্তু আগে আবিষ্কৃৃত লোহার খনির উৎসমুখ ভেলামারী থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে পাহারপুর গ্রামে পরীক্ষামূলক খনন করে চলে যান খনন কর্মীরা। ফলে পুনরায় খনিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এর পরও পেরিয়ে গেছে ২৩ বছর। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এলাকাবাসীর চোখে পড়েনি। এদিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার শালবাহানের তেল খনিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। এর পরপরই উত্তোলনের কার্যক্রম জোরদার করতে সরকারিভাবে বিশাল যান্ত্রিক গাড়ির বহর প্রবেশ করে শালবাহানে। ১৯৮৯ সালে ফ্রান্সের ফস্টাল কোম্পানি ভূমি থেকে মাত্র ৬ হাজার ফুট নিচে তেলের স্তরের সন্ধান পায়। পরে ৮ হাজার ফুট গভীরে ১২ ইঞ্চি ব্যাসার্ধবিশিষ্ট তেলকূপ খনন করে। তেল প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ নিজে এসে শালবাহান তেল খনির উদ্বোধন করেন এবং অবিলম্বে এ তেল খনি থেকে তেল উত্তোলনের ঘোষণা দেন। এর কিছুদিন পর রহস্যজনকভাবে ওই এলাকায় তেল নেই বলে খনন করা কৃপটি সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের তেল প্রাপ্তির সম্ভাবনার আঁতুড়ঘরেই মৃত্যু ঘটে। এদিকে নওগাঁর খনিজ শিল্প চীনামাটি ৫৪ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৬৮ সালে উত্তরাঞ্চলে তৎকালীন সরকার খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে নওগাঁর বর্তমান পত্নীতলা উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে আমবাটি গ্রামের একটি পুকুরের পাশে চীনামাটির খনিটি আবিষ্কৃত হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ফুট গভীরে উন্নত ও উৎকৃষ্টমানের চীনামাটির খনি আবিষ্কৃত হলে সে সময় পুরো উত্তরাঞ্চলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রায় একই সময় জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে চুনাপাথর ও কয়লা খনির সন্ধান পাওয়া যায়। জানা গেছে, জরিপ দল কয়লার স্তর বিন্যাস ও মান নির্ণয়ের সময় কয়লার পাশাপাশি চুনাপাথরের মতো এ চায়না ক্লে বা চীনামাটির সন্ধান পায়। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে প্রকল্পটি ফাইলচাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকার এ খনিজ সম্পদের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি। এ ছাড়া জামালগঞ্জের কয়লা ও চুনাপাথরের খনি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। জানা গেছে, ১৯৬২ সালে খনিটির সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ ও তৎকালীন খনিজ সম্পদ কর্তৃপক্ষ জামালগঞ্জ কয়লা খনিতে জরিপকাজ পরিচালনা করেন। অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়ার পর সরকারিভাবে প্রায় ২ দশমিক ৮৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং কয়লা আছে কি না তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার পর জায়গাটিকে সংরক্ষিত হিসেবে গণ্য করে। ১৯৭৯ সালে জরুরিভাবে অতিথিশালা, কোয়ার্টার বিল্ডিং ও গুদামঘর নির্মাণ করা হয়।

তখন কর্মকর্তারা এসব জায়গায় বসবাস করতেন। এরপর হঠাৎ ১৯৮১ সালে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এ স্থান ত্যাগ করেন। এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদদের অভিমত, উত্তরাঞ্চলের এ চার খনি উত্তোলন হলে দেশের চেহারাটাই পাল্টে যাবে। ভারতের টাটা কোম্পানির মতো এখানেও দেশি কোম্পানি গড়ে উঠবে। অর্থনীতির আমূল পরিবর্তনসহ বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে লাখ লাখ মানুষ। গোটা উত্তরাঞ্চল থেকে দারিদ্র্য নামক শব্দটি দূর হয়ে যাবে। খালাসপীর কয়লা খনি প্রকল্পের ডিজিএম ভূতত্ত্ববিদ অনুপ কুমার রায় ফরিগঞ্জের লৌহ খনি সম্পর্কে বলেন, লোহায় যে পরিমাণ খনিজ পদার্থ থাকা দরকার তা না পাওয়ায় ওই সময় খনির কাজ বন্ধ হয়। অন্য তিনটি খনি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেন খনিগুলো খনন করা হয়নি এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে জরিপ বিভাগ।

সর্বশেষ খবর