রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাজুস ফেয়ারের পর্দা নামল

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাজুস ফেয়ারের পর্দা নামল

বাজুস ফেয়ারের সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ফেয়ারে অংশগ্রহণকারী প্যাভিলিয়ন স্বত্বাধিকারীদের মধ্যে ক্রেস্ট বিতরণ করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পর্দা নেমেছে বাজুস ফেয়ার-২০২৩ দ্বিতীয় আসরের। জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গতকাল রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) নবরাত্রি হলে ফেয়ারের কর্মযজ্ঞ শেষ হয়েছে।

সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। তিনি বলেন, খ্রিস্টপূর্ব ৪ হাজার বছর আগে থেকেই সারা পৃথিবীতে চলছে জুয়েলারি মার্কেট। বাংলাদেশের গহনার যে মাকের্ট, আমি মনে করি আমাদের এই যাত্রা অনেক দূর নিয়ে যাবে। একটা সময় বিশ্বে একটাই জায়গা ছিল গার্মেন্ট।

মানুষ জানত গার্মেন্ট মানেই সারা পৃথিবীতে নতুন ব্র্যান্ড। অথচ আমাদের গহনাও যে ব্র্যান্ড হতে পারে, এটা দেখাতে আপনারা কাজ শুরু করলেন। আমি মনে করি এই যাত্রা আপনাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি আগামী দিনে গহনা বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশকে নতুন নতুন জায়গায় পরিচিত করবে। আপনারা বিশ্বকে জয় করবেন। গার্মেন্ট নয়, গোল্ড আমাদের নতুন জায়গা তৈরি করবে। আপনাদের কারণে ইকোনমিতে নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে। আপনাদের কারণে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ একটা রোল মডেল। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা একটা জায়গা তৈরি করেছেন। সেই জায়গাটা আমাদের তৈরি হয়েছে, এটাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। এগিয়ে নিতে হবে এবং সেটা আপনারা করবেন। তিনি বলেন, বাজুসের এই মেলার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। এটা বিগিনিং। আপনারা এটা অব্যাহত রাখবেন। বাংলাদেশকে আপনারা আগামী দিনে উন্নত বিশ্বে একই ধরনের মেলার আয়োজন করবেন। বাংলাদেশের শিল্প বাণিজ্য ব্যবসা জুয়েলারিতে আপনারাই আগামী দিনের পথপ্রদর্শক, পথ দেখাবেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাজুসের সাবেক সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার রায়, বাজুসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন খোকন। বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্রেড অ্যান্ড ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সদস্যসচিব উত্তম ঘোষ, ভাইস চেয়ারম্যান নারায়ণ দে, চেয়ারম্যান উত্তম বণিক। ফেয়ারে অংশগ্রহণকারী জুয়েলারি মালিকদের বাজুস ফেয়ার-২০২৩ সম¥াননা স্মারক তুলে দেন প্রধান অতিথি। ফেয়ারের শেষ দিনও ছিল ক্রেতা-দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে বিশেষ ছাড় দেওয়ায় বেচাকেনা ছিল জমজমাট। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, এবারের বাজুস ফেয়ারে ৫০টি জুয়েলার্স অংশ নেয়। এর মধ্যে ৮টি প্যাভিলিয়ন, ১২টি মিনি প্যাভিলিয়ন ও ৩০টি স্টল ছিল। অংশগ্রহণকারী জুয়েলার্সগুলো নতুন নতুন ডিজাইনের অলঙ্কার প্রদর্শন করে নানা রকম অফার দিয়ে গহনা বিক্রি করেছে। ফলে ফেয়ারে আগত ক্রেতারা সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক কম দামে সোনার গহনা ও ডায়মন্ড কিনতে পেরেছেন। ফলে দ্বিতীয় বাজুস ফেয়ারের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত জমজমাট ভিড় দেখা গেছে। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। ফেয়ারের শেষ দিন গতকাল সকালে ‘অর্থনীতিতে জুয়েলারি শিল্পের অবদান ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, খনিপ্রধান দেশ কিন্তু স্বর্ণ ব্যবসায় অগ্রসর হয়নি। এগিয়েছে যারা কাঁচামাল আমদানি করে স্বর্ণ রপ্তানি করেছে। রপ্তানি বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে গেলে আমাদের আমদানিও বাড়াতে হবে। প্রতিবছর ৪ হাজার ৭০০ টনের মতো স্বর্ণ লেনদেন হয়ে থাকে। বলার বিষয় হলো, ১০টি বড় দেশের মধ্যে ৬টিই এশিয়ার দেশ। এটিও আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা। আমাদের দেশে স্বর্ণের বাজার কত বড়, সেটি আমরা জানি না। এটির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকতে হবে বিনিয়োগকারীদের কাছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, ‘আমাদের যে রপ্তানি আয়, সেটার ৮৬ শতাংশ আসে একটা খাত থেকে। এত দিন ধরে আমাদের দেশ একটা খাতের ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, এটা আসলে খুব সুবিধাজনক কিছু না। আমরাও চাই রপ্তানি আয় বিকেন্দ্রীকরণ হোক। আমরা যখন টাকা জমাই তখনো আমরা বিভিন্ন জায়গায় জমাই, যাতে একটা জায়গা ধসে গেলেও বিপদ না হয়। সে জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নতুন সেক্টর এলে আমরাও সেটাকে সহায়তা করতে চাই। আপনাদের ইস্যুগুলো নিয়ে বাজুসের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিন, আমরা যাতে সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারি।’ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের দক্ষতার পাশাপাশি কারিগর রয়েছে। সবই আছে। কিন্তু আমরা এ বাজার ধরতে পারলাম না। আমাদের রাজস্ব বিভাগের একটা প্রবণতা ছিল, স্বর্ণকে নিষিদ্ধ করা। এর মাধ্যমে আমাদের রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। এ শিল্পের প্রসারে সরকারিভাবে আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। এটা হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ।’ বিআইআইএসএসের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির বলেন, ‘আমরা শুধু উৎসবকে কেন্দ্র করে স্বর্ণকে একটা বিনিয়োগ হিসেবে দেখি। আমাদের স্বর্ণকে একটা নৈমিত্তিক ভোগ্যপণ্য হিসেবে চিন্তা করতে হবে। ক্যারেট কমিয়ে বা অন্যভাবে এটা করা সম্ভব। ভালো মূল্যে পণ্য অবশ্যই তৈরি করবেন। একই সঙ্গে ডিজাইনের ক্ষেত্রেও উৎসবকেন্দ্রিক চিন্তা বাদ দিয়ে একটু ভিন্ন ধরনের ডিজাইন চিন্তা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের এসএমই লোনের ক্ষেত্রেও যে পলিসি আছে, সেটি পরিবর্তনের জন্য আপনাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এতে করে ডিজাইন ও ক্যাপিট্যালের জায়গাটায় আপনারা এগিয়ে যেতে পারবেন। পাশাপাশি একটি ভিশন ঠিক করতে হবে।’ একই দিন বিকালে ‘জুয়েলারি শিল্পের দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যেক্তাদের ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারের অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিজনেস এডিটর রুহুল আমিন রাসেলের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন বাজুস কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ড. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি সদস্য ইউমেন অ্যাফেয়ার্স তাসনিম নাজ মুনা। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাজুসের সাবেক সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার রায় বলেন, একটি ভয়ংকর অধ্যায় ছিল অতীতের স্বর্ণ ব্যবসার। কোনো আইন ছিল না। নিরাপত্তা ছিল না। ফলে উদ্যেক্তাদের সকালে ঘুম ভাঙত আতঙ্কে। কখনো চোরাই স্বর্ণ বা ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তাদের হয়রানি। আজ সেই অন্ধকার যুগের অবসান হয়েছে। আমাদের সভাপতির নেতৃত্বে এখন আর সেই ভয় নেই। গত এক বছরের  তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই শিল্প গোলাপে প্রস্ফুটিত হয়েছে। ফলে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আগামী দিনেও এই শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় খাত হবে এই শিল্প। মূল বক্তব্যে তাসনীম নাজ মুনা বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে বাড়াতে হলে পর্যায়ক্রমের প্রক্রিয়ার মাধ্য এই শিল্পেও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রযুক্তিতে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। উৎপাদন ও ভোক্তার মধ্যে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে। এতে অর্থ ও সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি নকশায়ও ভিন্নতা আসবে।  এ জন্য স্বর্ণশিল্পীদের জন্য ডিজাইন ইনস্টিটিউট করার পরামর্শ দেন তিনি। জড়োয়া হাউসের পরিচালক অভি রায় বলেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে প্রযুক্তির সঙ্গে সময়োপযোগী শিক্ষাসহ আধুনিক মেশিনারির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে হবে। এ কারণে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। এ জন্য তিনি তৈরি পোশাকশিল্পের মতো জুয়েলারি স্কুল করার পরামর্শ দেন। বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ও আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার আজাদ আহমেদ বলেন, বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আসলাম খান বলেন, সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে স্বর্ণশিল্প নতুন মাত্রা পাবে।  রিপনুল হাসান বলেন, ‘বর্তমান সভাপতির নেতৃত্বে সাহসের বর্ণিল ঠিকানা পেয়েছি। স্বপ্ন দেখছি, বসুন্ধরা গ্রুপের মাধ্যমে স্বর্ণের কাঁচামাল বাজারে এলে এই বছরই রপ্তানিতে যাব।’ এর আগে বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) নবরাত্রি হলে তিন দিনের এ ফেয়ার উদ্বোধন করেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর