বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বীর নিবাস পেলেন ৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা

কোনো মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবনযাপন করবে না : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবনযাপন করবে না। একজন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করবে বা রিকশা চালাবে বা মানবেতর জীবনযাপন করবে, অন্তত আমি জাতির পিতার কন্যা ক্ষমতায় থাকতে এটা কখনো হতে পারে না। গতকাল পাঁচ জেলায় অসচ্ছল প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৫ হাজার বাড়ির (বীর নিবাস) চাবি হস্তান্তরকালে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর ও নড়াইলের জেলা প্রশাসকরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ‘বীর নিবাস’র চাবি হস্তান্তর করেন। অনুষ্ঠানে ‘বীর নিবাস’র ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। দুটি শয়নকক্ষ, একটি বসার ঘর, একটি রান্নাঘর এবং একটি করিডরসহ একতলাবিশিষ্ট প্রতিটি ‘বীর নিবাস’ ১৪ দশমিক ১০ লাখ টাকায় নির্মিত এবং দেশের জাতীয় পতাকার রং লাল-সবুজে করা। এ ছাড়া রান্নাঘরের পাশে একটি সিমেন্টের উঠান, একটি নলকূপ, একটি বাথরুম এবং গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির শেড রয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের ১৬ মার্চ সরকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ ও প্রয়াত যুদ্ধ বীরদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ৩০ হাজার বাড়ি নির্মাণের জন্য ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রধানমন্ত্রী যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তরুণ প্রজন্মের সামনে তা তুলে ধরতে এবং বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে সারা দেশের অনাবিষ্কৃত বধ্যভূমিগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো সংরক্ষণের জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি এই বাংলাদেশের ওপর আর কারও কালো থাবা যেন না পড়ে সে জন্য দেশবাসীকে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তা এখন ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাদের ঘরবাড়ি নেই এবং মানবেতর জীবনযাপন করছিল সেটা আমাদের জন্য লজ্জার ব্যাপার। তাই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে তাদের জীবন-জীবিকা এবং চিকিৎসা-যাতায়াতসহ নানা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তিনি বলেন, আজ ‘বীর নিবাস’ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমি আশা করি আরও যারা মুক্তিযোদ্ধা বাকি আছেন তাদের সবার জন্যই এ ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। সাধারণ গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষের জন্যও সরকার ঘর করে দিচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, আজ ৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার মাঝে বীর নিবাস হস্তান্তর করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৭ হাজার ৬৬০টি বীর নিবাসের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান রয়েছে।

 

আশা করি এ বছরের মধ্যে ৩০ হাজার বীর নিবাস নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। যদিও করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও স্যাংশনের কারণে আমাদের খুবই হিসাব করে চলতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেন খাদ্যের অভাব না হয় সে জন্যই আমরা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। সে জন্যই আমার এ আহ্বান, যে যেখানে পারেন প্রত্যেকেই কিছু না কিছু উৎপাদন করেন। নিজে খান, অন্যকেও খাওয়ান।

সরকারপ্রধান বলেন, আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ। ইউনিয়ন পর্যন্ত অনলাইনে যোগাযোগের ব্যবস্থা আমরা করেছি। তাছাড়া রাস্তাঘাট ও পুল করেছি, এসবের উন্নতি করে দিয়েছি। বাংলাদেশ এই ১৪ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন করেছি এবং আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। জাতির পিতা মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে এ দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিয়েছি। দলমত নির্বিশেষে সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য এই সম্মানের ব্যবস্থা আমরা করেছি। ’৭১ সালে যারা জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে আমাদের বিজয় এনে দিয়েছেন, তাদের সম্মান দেখানো আমাদের কর্তব্য মনে করি। তিনি বলেন, সে জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেলে যেন রাষ্ট্রীয় সম্মান পায় সে ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া আমরা সরকারে আসার পর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানরা যেন বংশপরম্পরায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়, সে ব্যবস্থাও আমরা করেছি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের অনলাইনে ভাতা দেওয়া এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদানের জন্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজও গড়ে তুলেছে। এটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজের সঙ্গেও সংযুক্ত রয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এখনো অনেক জায়গা অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে সেগুলো খুঁজে বের করবেন। ইতোমধ্যে প্রায় ২০ হাজার সমাধিস্থল সংরক্ষণ করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ২৯৩টি উপজেলার ৩৬০টি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ বা জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি উপজেলায় আলাদা মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স করা হচ্ছে। এতে মানুষ জানতে পারবে এই যুদ্ধ আমাদের জন্য কত গৌরবের ছিল বা কাদের আত্মত্যাগে এই স্বাধীনতা অথবা কাদের আত্মত্যাগে আজকে এই সম্মান পাচ্ছি। সেটা যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষ স্মরণ করতে পারে।

‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে যে বিজয় অর্জন করেছি, সেটা যেন মানুষ ভুলে গিয়েছিল’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে দায়মুক্তি দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, তারাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা হয়ে ক্ষমতায় বসেন। স্বাভাবিকভাবে তখন মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হলে চাকরি দেওয়া হতো না। এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিবেশ ছিল ২১ বছর। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতা যাওয়ার জন্য এই ১৫ ফেব্রুয়ারি একটা ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিল। যে নির্বাচনে ২ শতাংশ ভোটও পড়েনি। সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে, জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে খালেদা জিয়া নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে এই ঘোষণা দেয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভোটের অধিকার নিয়ে অনেক সচেতন। তাদের ভোট চুরি হয়েছিল বলে আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের ফলে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সে জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করার একটা দিন।

এ ছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে এরশাদ সরকার এই ১৫ ফেব্রুয়ারিতেই তাঁকে এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের প্রায় ৪০ জন নেতাকে গ্রেফতার ও বন্দি করে বলেও তিনি জানান।

সর্বশেষ খবর