শুক্রবার, ১৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংকটে জাহাজভাঙা শিল্প

যুক্ত হয়েছে লাল শ্রেণিতে, লাগবে অতিরিক্ত সময়, গুনতে হবে বাড়তি সুদ

আজহার মাহমুদ, চট্টগ্রাম

সংকটে জাহাজভাঙা শিল্প

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার ও এলসি সংকট এবং করোনার কারণে দীর্ঘদিন প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছে জাহাজভাঙা শিল্প। সাম্প্রতিক সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকা সম্ভাবনাময় শিল্পটিকে ‘কমলা’ থেকে পুনরায় ‘লাল’ শ্রেণিতে নেওয়ায় উদ্বিগ্ন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতে জাহাজ কাটতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি জাহাজ কাটতে দুই মাস বাড়তি সময় লাগবে। ব্যাংকে বাড়তি সুদ দিতে হবে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) প্রেসিডেন্ট আবু তাহের বলেন, ‘লাল শ্রেণিতে নেওয়ায় জাহাজ কাটায় জটিলতা তৈরি হচ্ছে। জাহাজ কাটার জন্য ঢাকায় পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক থেকে প্রতিটি জাহাজের জন্য আলাদা ছাড়পত্র নিতে হবে। এতে অন্তত দুই মাস বাড়তি সময় লাগবে। বাড়তি সময়ে বারবার ঢাকায় ধরনা দেওয়াসহ অহেতুক নানা জটিলতা তৈরি হবে। এ সময়ে এলসির বিপরীতে ব্যাংকেও বাড়তি সুদ দিতে হবে।’ বিএসবিআরএ ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম আল মামুন বলেন, ‘বেশকিছু দিন ঝিমিয়ে থাকার পর ব্যাংক এখন কিছু এলসি দিচ্ছে। ৪০টির মতো জাহাজ আনা হয়েছে। পুরোটাই ব্যাংকের টাকা। কিন্তু ছাড়পত্রের জন্য কাটা যাচ্ছে না। একটা জাহাজ কাটার ছাড়পত্র পেতে যদি দুই মাস লাগে, জাহাজ সাগরে পড়ে থাকে, তাহলে লাভের চেয়ে ব্যাংকের সুদ বেশি আসবে। আমরা পরিবেশ ও শিল্পমন্ত্রী, সচিবদের জানিয়েছি।’ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩-এ পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব বিবেচনায় শিল্প-কারখানা, সেবামুখী প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে যেগুলোর প্রভাব খুব কম সেগুলো সবুজ, যেগুলো মধ্যম মাত্রায় প্রভাব রাখে সেগুলো হলুদ এবং যেগুলোর প্রভাব যথেষ্ট ও পরিবেশগত প্রভাব কমানো দরকার সেগুলো কমলা শ্রেণিভুক্ত। আর যেগুলোর প্রভাব তীব্র ও দূষণ কমাতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার সেগুলো লাল শ্রেণিভুক্ত। সবুজ শ্রেণিতে আছে ছাপাখানা, বেকারি, বরফকলসহ ৩২ ধরনের ছোট আকৃতির শিল্প। হলুদ শ্রেণিতে আছে পোলট্রি খামার, দিয়াশলাই মিল, করাতকলসহ ৩৭ ধরনের হালকা মাঝারি শিল্প। কমলা শ্রেণিতে আছে ডকইয়ার্ড, জুট মিল, রিরোলিং মিলসহ ১১৩ ধরনের শিল্প ও প্রকল্প। লাল শ্রেণিতে আছে সমরাস্ত্র কারখানা, রেললাইন নির্মাণ, জাহাজভাঙাসহ ৭২ ধরনের শিল্প ও প্রকল্প। বিএসবিআরএ নেতারা জানান, ১৯৯৭ সালের বিধিমালায় জাহাজভাঙা শিল্প কমলা-খ শ্রেণিভুক্ত ছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের নভেম্বরে সরকারের এক নির্বাহী আদেশে এ শিল্পকে লাল শ্রেণিভুক্ত করা হয়। এর ফলে সম্ভাবনাময় এ শিল্পের কার্যক্রম কঠিন হয়ে পড়ে। শিল্প মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে ২০২১ সালের নভেম্বরে এ শিল্পকে পুনরায় কমলা শ্রেণিতে আনলে কার্যক্রম কিছুটা সহজ হয়। বিএসবিআরএ নেতারা বলছেন, গত কয়েক বছর শিল্প ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এবং এ শিল্পের সার্বিক উন্নতি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, গ্রিন ইয়ার্ড নির্মাণ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রদান, ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ অ্যান্ড ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটি নির্মাণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মনোযোগী হন ব্যবসায়ীরা। এর অংশ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের গাইডলাইন অনুযায়ী নরওয়ে সরকারের অর্থায়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৭০০ শ্রমিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তিনটি ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে,  সাত-আটটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ৭৮টি ইয়ার্ড শিল্প মন্ত্রণালয়ের শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যানের অনুমোদন পেয়েছে। অন্যগুলোও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য শর্ত পূরণের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। জাহাজভাঙা কার্যক্রম দিন দিন উন্নত, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিপ রিসাইক্লিং বোর্ড, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসবিআরএর মতামত না নিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩-এ জাহাজভাঙা শিল্পকে আবার লাল শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।

 

বিএসবিআরএ সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এ খাত দুর্দিন কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আছে। ১৫০টি ইয়ার্ডের মধ্যে ৩৫-৪০টির মতো এখন সক্রিয়। এ শিল্পে গতি আনতে দীর্ঘদিন ওয়ান স্টপ সেবা চালুর দাবি জানানো হচ্ছে। সেখানে লাল শ্রেণিতে যাওয়ায় গতি উল্টো কমে যাবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে এই শিল্পের অগ্রগতির জন্য জাপানের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করলেও এ সিদ্ধান্তের কারণে তা ভেস্তে যাবে।’

বিএসবিআরএ নেতাদের ভাষ্য, অতীতে ইয়ার্ডগুলো অনুন্নত থাকার সময়ও এ শিল্প কমলা শ্রেণিতে ছিল। এখন সবাই গ্রিন ইয়ার্ড নির্মাণে মনোযোগী হচ্ছে। এ অবস্থায় লাল শ্রেণিতে নেওয়ার কারণে কাজের অনেক ধাপ বেড়ে গেছে। অনেক কিছু অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতাও চট্টগ্রাম অফিসের নেই। ঢাকা থেকে অনুমোদন আনতে যে বাড়তি সময় লাগবে তাতে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হবে। কমলা শ্রেণিতে না নিলে এ শিল্প ঝিমিয়ে পড়বে।

প্রসঙ্গত, লাল শ্রেণির শিল্প ও প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশগত নির্দেশনা মানার সর্বোচ্চ বাধ্যবাধকতা আছে। যে এলাকায় শিল্প স্থাপন কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে সে এলাকার বাতাস, পানি, মাটিসহ সার্বিক পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ওই শিল্প বা প্রকল্পের প্রভাব বিস্তারিত বর্ণনা করে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট আ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) করতে হয়। ইআইএ করলে ওই শিল্প ও প্রকল্পের দূষণের মাত্রা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর