নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে রাজস্ব আয়। এ ছাড়া কমে এসেছে কনটেইনার জট ও জাহাজের গড় অবস্থানকাল।
কোভিড অতিমারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। বিশ্বের অনেক বড় বন্দরে তখন কমে গিয়েছিল জাহাজের আগমন ও পণ্য পরিবহন। চট্টগ্রাম বন্দরেও তার কিছুটা ধাক্কা লাগে। এরপর চলতি বছর জুলাইয়ে দেশে শুরু হয় ছাত্র-জনতার বৈষম্যবরোধী আন্দোলন, যা আগস্টেও অব্যাহত ছিল।
ওই সময় আন্দোলন, কারফিউ ও ফেনী-কুমিল্লা অঞ্চলে সৃষ্ট বন্যার কারণে টানা কয়েক দিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি পণ্য ছাড় ও রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে তৈরি হয়েছিল অচলাবস্থা। বন্দরের অভ্যন্তরে দেখা দেয় কনটেইনার জট। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। এত সব প্রতিবন্ধকতার পরও চট্টগ্রাম বন্দর পণ্য পরিবহনে অর্জন করেছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
দেশের সমুদ্রকেন্দ্রিক আমদানি-রপ্তানির ৯২ শতাংশই হয়ে থাকে এই বন্দর দিয়ে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ।
বন্দর সূত্র জানায়, চলতি বছরের আগস্ট-অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৮ লাখ ৩০ হাজার ৫৮২ টিইইউএস (২০ ফুট সমমান)। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৬ হাজার ৯৮৬ টিইইউএস বেশি।
পণ্য পরিবহনে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি কনটেইনার জট নিরসন এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতেও সাফল্য এসেছে দাবি করে সূত্রটি জানায়, ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরে ৪৫ হাজারেরও বেশি কনটেইনার ছিল। অর্থাৎ মোট ধারণক্ষমতার প্রায় ৮৫ শতাংশ স্থান ভর্তি ছিল কনটেইনারে। তা কমিয়ে ৩৪ হাজারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে জাহাজের এভারেজ ওয়েটিং টাইম ৬-৮ দিন থেকে এক দিনে নেমে এসেছে। জাহাজ আসার পর দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন-অ্যারাইভাল বার্থিং মিলছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের গত চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বন্দরের ১ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে রাজস্ব উদ্বৃত্তও ২৮ দশমিক ০১ শতাংশ বেশি হয়েছে।
দক্ষতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণ সম্ভব হয়েছে বলে দাবি বন্দর কর্তৃপক্ষের। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। এই প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও বন্দর কর্তৃপক্ষ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কার্গো এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। পদ্ধতিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ইয়ার্ডগুলোতে জমে থাকা কনটেইনার স্বাভাবিক অবস্থায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগে ব্যবহারকারীরা (স্টেকহোল্ডার) সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেশি হওয়া, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং জাহাজের অবস্থানকাল কমে আসা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে হ্যান্ডলিং বাড়ানো কঠিন কাজ। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
চট্টগ্রামের ম্যালো ফ্যাশনের কর্ণধার ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক সাইফ উল্লাহ মনসুর বলেন, বন্দরের এখন আগের চেয়ে জবাবদিহি বেড়েছে। কোনো সমস্যা হলে আমরা বন্দর চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারছি। ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা আছে কর্তৃপক্ষের। এটা প্রশংসনীয়। এই উন্নতি ধরে রাখতে পারলে হ্যান্ডলিংয়ে গতি আরও বাড়বে।