অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৪ মাসে কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় বেসরকারি খাতের সংকট আরও গভীর হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে কর্মী ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে চাকরিপ্রত্যাশীদের লাইন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার তাগিদে দেশে ভাসমান উদ্যোক্তা বাড়ছে। শ্রমজীবী অল্পশিক্ষিতদের পাশাপাশি শিক্ষিত তরুণরাও যুক্ত হচ্ছেন এই তালিকায়। তবে এসব উদ্যোক্তার নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট অংশে সতর্ক করে বলছে, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ১২০ কোটি তরুণের বিপরীতে মাত্র ৪০ কোটি চাকরির বাজার তৈরি হবে।
সেই হিসাবে প্রায় ৮০ কোটি তরুণ-তরুণী বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়াবে। অক্টোবর ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্রুত বেড়েছে। ২০১৩ সালে দেশে মোট বেকারের ৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল উচ্চশিক্ষিত তরুণ, যা ২০২২ সালে বেড়ে ২৭
দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলেও উচ্চশিক্ষিত স্নাতকদের চাকরি খোঁজার জন্য বেশির ভাগ সময় হিমশিম খেতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীজুড়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাসমান উদ্যোক্তা বেড়েছে। শ্রমজীবী অল্পশিক্ষিতদের পাশাপাশি শিক্ষিত তরুণরা সব থেকে বেশি এগিয়ে রয়েছেন। এসব উদ্যোক্তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পর্যটন এলাকাগুলোতে ফুডকোট, টি স্টল ও রকমারি পণ্যের ব্যবসা করছেন এবং এদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। তেমনি একজন চাকরিপ্রত্যাশী শাহিনুর তালুকদার প্রিয়তি। কয়েক মাস আগেও একটা কল সেন্টারে চাকরি করতেন। প্রাপ্য বেতনে খরচের চাপ কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না বলে মহাখালী এলাকায় তিনি খাবার বিক্রি করছেন। প্রিয়তি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পড়াশোনার খরচ চালাতে ১৩ হাজার টাকায় একটা ভিসা সেন্টারে চাকরি নিয়েছিলাম। বেতনের এই টাকায় টেনেটুনে বাসাভাড়া ও খাবারের খরচ চালিয়ে নিতে পারলেও অন্যান্য খরচের জন্য প্রতি মাসেই ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা ঋণ করতে হতো। তাই চাকরি ছেড়ে ফুটপাতে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা খাবার বিক্রি করে মাসে ২০ থেকে ২১ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।’
তিতুমীর কলেজের দ্বিতীয় গেটে ফাস্টফুড বিক্রি করা আরেক চাকরিপ্রত্যাশী ও উদ্যোক্তা হাসিবুল আলম বলেন, ‘কল সেন্টারে চাকরি করে ১০ হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে পড়াশোনা করতে শহরে টিকে থাকা সম্ভব না। তাই ব্যবসা করছি।’
চলতি অর্থবছরে সরকার তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সুদবিহীন ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পর উদ্যোক্তা পর্যন্ত এই ঋণ পৌঁছাচ্ছে কি না, তা নিয়ে একটা ধোঁয়াশার শঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সরকার উদ্যোক্তাদের জন্য যে তহবিল গঠন করেছেন তা ব্যবসায়ীদের কাছে পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা নেই। অনেক ক্ষেত্রে এই ঋণ না পাওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষ একধরনের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুরুতে ব্যবসার ধরন অনুযায়ী উদ্যোক্তাদের অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্সসহ নানা নথিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এসব নথি বিলির ক্ষেত্রে সহজ প্রক্রিয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু তারা এখনো তা বাস্তায়ন করতে পারেনি। এর জন্য অধিকাংশ উদ্যোক্তা লাইসেন্সে অনীহা রয়েছে। তবে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে সরকার ‘ট্রেড লাইসেন্স অটোমেটিক করে দেওয়া, এককালীন ফিতে সামান্য কিছু ডকুমেন্টের সুবিধা’ পেলে উদ্যোক্তারা লাইসেন্সে আগ্রহী হবেন। পাশাপাশি লাইসেন্স রিনিউর ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া সরকার ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রীয় সুবিধার আওতায় আনতে পারবে না। ইন্টিরিম সরকার তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য যে ফান্ড গঠন করেছিল তারা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে সে বিষয়ে আমরা এখনো ক্লিয়ার না।’