মোংলা-ঘোষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলের নাব্য সংকট দূর করে সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। একদিকে বিআইডব্লিউটিএর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ড্রেজিং করতে গিয়ে খননকৃত বালুমাটি ফেলার জায়গা পাচ্ছে না। অন্যদিকে ড্রেজিং বন্ধ করলে দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলটি। এই অবস্থায় জনগুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলটি ড্রেজিং করে সচল রাখার পাশাপাশি প্রতিবেশ-পরিবেশ ঠিক রাখতে খননকৃত বালুমাটি ফেলতে পার্শ্ববর্তী জমি অধিগ্রহণই একমাত্র পথ বলছে মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা। এটা না করা হলে মোংলা-ঘোষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলের নাব্য সংকটের পাশাপাশি সুন্দরবন সুরক্ষায় ও মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের নাব্য সুরক্ষায় আবারও মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফারাক্কা বাঁধের কারণে উজান থেকে পানির স্রোত কমে যাওয়াসহ আশির দশক থেকে প্লাবন কৃষি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দিয়ে চিংড়ি চাষের কারণে ভারতের সঙ্গে নৌপ্রোটকলভুক্ত মোংলা-ঘোষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলসহ বাগেরহাটের নদী-খালের নাব্য সংকট সৃষ্টি হয়। তীব্র পলি জমে ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভরাট হয়ে যায় মোংলা ঘোষিয়াখালী নৌচ্যানেলটি। এই অবস্থায় সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে লাইটার কার্গোসহ তেলবাহী ট্যাংকারগুলোকে ৮৪ কিলোমিটার ঘুরে যাতায়াত করতে হয়।
২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবিতে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েলের হাত থেকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে খোদ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের ছুটে আসতে হয়। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মোংলা-ঘোষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলটি খননের সিদ্ধান্ত নেয় বিআইডব্লিউটিএ। ওই বছরের ১ জুলাই শুরু হয় খননের ড্রেজিং কাজ। ড্রেজিং শেষে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই চ্যানেলটি উন্মুক্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। চ্যানেলটি থেকে এ পর্যন্ত ড্রেজিং করে ৩৩৮.৯৭ লাখ ঘনমিটার পলি উত্তোলন করা হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা। চ্যানেলের বর্তমান গভীরতা ভাটার সময় ১৬ ফুট ও প্রশস্ত ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। বর্তমান অর্থ বছরে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা শিপইয়ার্ডের চারটি ড্রেজার সার্বক্ষণিক খনন কাজ করছে। ড্রেজিং চালিয়ে যাওয়ায় দিনের জোয়ারের সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করছে। ড্রেজিং শেষে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর চ্যানেলটি উন্মুক্ত ঘোষণার পর অদ্যাবধি ১ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি লাইটার ভ্যাসেল মালামাল নিয়ে চলাচল করেছে। মোংলা ঘোষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট শেখ মহিউদ্দিন জানান, এখন প্রতি বছর ড্রেজিং করে চ্যানেলটি সচল রাখা হলেও সার্বক্ষণিক নৌযান চলাচল ও প্রশস্ততা বাড়ানো হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো দ্বিমুখী ও রাত্রিকালীন নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছে। চ্যানেলটিকে সচল রাখতে সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও দুই পাশের কৃষি জমি সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করা হয়নি। চিংড়ি খামারের কারণে প্লাবন ভূমি না থাকায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে। এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ঠিক রাখতে দ্রুত ড্রেজিং করা বালুমাটি ফেরতে পতিত জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবন রক্ষা, মোংলা বন্দর সচল রাখাতেও নদী চর দখল বন্ধ করতে হবে। এখনো মোংলা-ঘোষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলসহ বন্দরের আশপাশের নদী চর কাঁটাতার ও সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দখল করছে প্রভাবশালীরা। এতে করে নদী সংকুচিত হচ্ছে। যে কারণে নদীর গতি ব্যাহত হচ্ছে। নদী রক্ষায় নীতিমালা ও মহামান্য হাই কোর্টে রায় মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। নদী-খাল ও জলাভূমি রক্ষা করতে না পারলে সব উন্নয়নের সুফল মিলবে না। এটা না করা গেলে মোংলা-ঘোষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেলের নাব্য সংকটের পাশাপাশি সুন্দরবন সুরক্ষায় ও মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের নাব্যতা সুরক্ষায় আবারও মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মোংলা-ঘোষিয়াখালী ড্রেজিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আ. মতিন জানান, এই আন্তর্জাতিক নৌরুট সচল রাখতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। চ্যানেলে মোংলা বন্দর পয়েন্ট থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলার জায়গা নেই। এ জন্য ড্রেজিং ব্যাহত হচ্ছে। মাটি অপসারণেও নানান জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। মোংলা পৌরসভার রাস্তা ব্যবহারের কারণে রাস্তা নষ্ট হওয়ায় তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। ড্রেজিং অব্যাহত রাখতে এখন জমি অধিগ্রহণসহ এই চ্যানেলটির জোয়ার-ভাটা নির্বিঘ্ন রাখতে চ্যানেলের তীরভূমি ও প্লাবনভূমি উন্মুক্ত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।