গুলশান হামলার সন্দেহভাজন মূল পরিকল্পনাকারী নুরুল ইসলাম মারজানের বাবাকে আটকের বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। গত সোমবার রাতে পাবনার আফুরিয়া গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি পরিবারের। তবে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেও তার কোন খোঁজ না পেয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় সময় পার করছেন তারা।
সোমবার সন্ধ্যায় মারজানের পরিচয় জানাজানি হলে তার বাড়িতে ভিড় করেন গণমাধ্যম কর্মীরা। এ সময় মারজানের বাবা নিজাম উদ্দিন তার ছেলের পরিচয় নিশ্চিত করেন। এর কিছু সময় পরে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন সাদা পোশাকধারী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে যায় বলে জানান পরিবারের সদস্যরা।
তবে নিজাম উদ্দিনকে আটকের বিষয়টি স্বীকার করেননি পাবনা জেলা পুলিশ। পুলিশের দাবি, এ বিষয়ে তাদের কাছে কোন তথ্য নেই। পরিবারের দাবি মারজান অপরাধী হয়ে থাকলে তার প্রাপ্য শাস্তি তাকে দেয়া হোক, কিন্তু ছেলের অপরাধে মারজানের বাবা কিংবা স্বজনদের যেন হয়রানী করা না হয়।
মারজানের দাদী ইয়ারুন নেছা বলেন, আমার নাতি অপরাধ করে থাকলে তার বিচার হোক, কিন্তু আমার ছেলেকে কেন শাস্তি পেতে হবে? ছোট ছোট ৯ ছেলে মেয়ে নিয়ে তার সংসার। একদিন কাজ না করলে এই পরিবারে খাবার জুটবে না। সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
নিজাম উদ্দিনকে যারাই ধরে নিয়ে যাক না কেন, দ্রুত তাকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি করেন ইয়ারুন নেছা।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া মারজানের বোন আফিয়া সুলতানা আশা বলেন, আমার ভাই জঙ্গি হওয়ার খবর শুনার পর থেকেই আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আমার বড় ভাই অসুস্থ, বাবা কাজ না করলে আমাদের সংসার চলে না। আমাদের কে দেখবে, কী খাব? কথা বলতে বলতে কান্না শুরু করে মেয়েটি।
ঘরে গিয়ে দেখা যায় মারজানের মা চুপচাপ শুয়ে আছেন, পাশে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বসে আছে।
একাধিক প্রতিবেশীরা জানান, মারজান অপরাধী কিন্তু ওর বাবা তো নিরাপরাধ মানুষ। তাকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, এটাই আমাদের নিকট এখন প্রশ্ন। তারা আরও জানান, প্রায় বছর খানেক আগে বিয়ে করার পর থেকেই মারজান বাড়িতে অনিয়মিত ছিল। পরিবারের লোকজনের ধারণা ছিল, বিয়ের পর সে সংসার নিয়ে ব্যস্ত আছে, তাই বাড়িতে আসে না।
আটকের আগে মারজানের বাবা নিজাম উদ্দিন বলেন, আমি খুব কষ্ট করে আমার ছেলেকে পড়াশুনা করাতাম। বেশ কিছু দিন ধরে সে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতো না। আমাদের ধারণা ছিল বিয়ে করার কারনেই হয়তো আমাদের এখানে আসে না। গত ৭ মাস সে বাড়ি আসেনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম প্রথম ভালই যোগাযোগ ছিল, বছর খানেক হলো বিয়ে করে। বিয়ের পর থেকেই সে বাড়িতে কম কম যাতায়াত করতো। সর্বশেষ গত ৭/৮ মাস পূর্বে সে বাড়ি এসে বউ নিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে মারজানের আর খোঁজ ছিল না।
মারজানের বাবা-মা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আর্থিক অনটনে বেড়ে উঠেছেন মারজান। আফুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে তিনি পাবনা শহরের পুরাতন বাঁশবাজার আহলে হাদিস কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এরপর পাবনা কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে দাখিল ও আলিম পাস করেন। এরপর ২০১৪ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে।
এ ব্যাপারে পাবনা আহলে হাদিস মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুর রহমান জানান, আমি গত রমজান মাসে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করি। এ খবর পেয়ে আমাদের খাতা পত্র দেখে জানতে পারি নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে এখানে লেখাপড়া শেষ করে চলে যায়। তবে এখানে থাকাকালীন সময়ে সে অত্যান্ত ভদ্র ও ভাল ছাত্র ছিল। সে পর পর দুই বার বিভাগীয় কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এখান থেকে চলে যাওয়ার পর সে কোন কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে তা এখানকার কেউই জানে না।
এদিকে মারজানের বাবাকে নিয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কেউই জানাতে পারছে না যে, তাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। পাবনার পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, বিভিন্ন সংস্থা আছে, কারা আসলে তাদের এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন আমাদেরও জানা নেই। পাবনা জেলা পুলিশ এই কাজের সাথে জড়িত না।
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ