কখনো সহকারী পুলিশ কমিশনার, কখনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ রকম নানা পরিচয়। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে একের পর এক বিয়ে করে অর্থ, সম্পদ হাতিয়ে নেয়াই তার কাজ। সহজ-সরল মানুষ সহজেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার। এমনকি পুলিশের অনেক কর্মকর্তাও জানতেন না তার প্রতারণার বিষয়টি। যে কারণে পুলিশের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্ব। জুনিয়রদের অনেকে তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওয়াকিটকি টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে ছবি শেয়ার করেছে সে। এসব দৃশ্য দেখে আন্দাজ করার উপায় নেই এ সবই মিথ্যা। সত্য হলো সে একজন প্রতারক। এই ভয়ঙ্কর প্রতারকের নাম হুমায়ুন কবির মাহমুদ আলম ওরফে কবির ওরফে আসাদুজ্জামান মাসুদ। কুমিল্লার একটি হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে কবির। তার পিতা একজন রিকশাচালক। বিত্তের মালিক হওয়ার জন্য প্রতারণাকেই বেছে নেয় সে। তার প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন অনেকে। সামাজিকতার কারণে মুখ খুলতে চান না তারা। শেষ পর্যন্ত রমনা থানায় একটি মামলা করেছেন প্রতারণার শিকার এক তরুণী। ওই মামলায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছে কবির।
রিমান্ডে পুলিশকে দেয়া কবিরের প্রতারণার অভিনব গল্প শুনে অবাক পুলিশ কর্মকর্তারা। কুমিল্লার একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে কবির। পরে গাড়ির ড্রাইভিং শিখে ঢাকায় কাজ করতো। পুলিশের ডিউটিতেও ব্যবহার হতো তার গাড়ি। এছাড়া প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তার গাড়ি চালিয়েছে কবির। ওই সময় থেকেই পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটদের আচরণ রপ্ত করেছে। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে গত পাঁচ বছর ধরে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তার ধারণা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে প্রতারণা করছে সে। তার প্রতারণার শিকার রাজধানীর বড় মগবাজারের ডাক্তারগলির বাসিন্দা, জনৈক ব্যাংক কর্মকর্তার মেয়ে। মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করেছেন ওই তরুণী। তিনি জানান, গত বছরের জুনে ভিসার জন্য ইন্ডিয়ান অ্যাম্বেসিতে যান। ওই সময়ে কবিরও সেখানে ভিসার জন্য ছিল। তখনই তার সঙ্গে পরিচয়। নিজেকে জার্মানপ্রবাসী পরিচয় দিয়ে সখ্য গড়ার চেষ্টা করে কবির। সে জানায়, তার বাবা অধ্যাপক ডা. মুবিন খান। শুধু তাই না, নিজেকে কুমিল্লা এলাকার একজন মন্ত্রীর ভাতিজা হিসেবেও পরিচয় দেয়। কবির তখন জানায়, সে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ফিজিক্যালি আনফিট দেখিয়ে জার্মানে অবস্থান করছে। সেখানে ল’ বিষয়ে পিএইচডি করছে। তার দুই বোন জার্মানিতে এবং এক ভাই আমেরিকায় থাকেন। ওই সময়েই ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয় দু’জনের। ফোনে কথা হতো নিয়মিত। এভাবেই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যায় কবির। একপর্যায়ে তরুণীর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়। উদ্দেশ্য তরুণীকে বিয়ে করা। ‘প্রতিষ্ঠিত’ ছেলের পরিচয় জেনেই মুগ্ধ তরুণীর মা। কবিরের প্রতারণার পথ প্রশস্ত হয় এভাবেই। গত বছরের আগস্টে সে জানায় তার চিকিৎসক পিতা মারা গেছেন। এখন সে এতিম। বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পরে আনুষ্ঠানিকতা হবে জানিয়ে ৫ অক্টোবর ওই তরুণীকে বিয়ে করে। বিয়ের পাঁচদিন পরেই নানা সমস্যার কথা বলে টাকা খুঁজে কবির। ওই তরুণীর পিতা তার ডিপোজিট ভেঙে ৬ লাখ টাকা দেন। কবিরের কথামতো গত বছরের ১১ অক্টোবর ব্র্যাক ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় টাকা জমা দেন ওই তরুণী।
তরুণী জানান, ১৫ অক্টোবর জার্মানি চলে যাচ্ছি বলে বিদায় নিয়ে যায় কবির। এভাবে প্রায়ই জার্মানি চলে যাচ্ছি বলে বিদায় নিতো। আবার সপ্তাহ-দশ দিন পর ফিরে আসতো। কবিরের পরিবারের কেউ তাদের যোগাযোগ করে না। এসব নানা কারণেই সন্দেহের জন্ম হয় তরুণীর স্বজনদের। এসব ক্ষেত্রে নানা কৌশল অবলম্বন করতো কবির। তরুণী বলেন, বুঝার কোনো উপায় ছিল না যে সে প্রতারক। কারণ অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ‘স্যার স্যার’ বলে সম্বোধন করতো। উদাহরণ হিসেবে জানান, বেইলি রোডে কবিরের গাড়ি (ঢাকা-মেট্টো-ক-১২-৪৩৮৬) আটক করেছিল ট্রাফিক। তখন ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে অনভিপ্রেত আচরণ করেছে। ওই সময়ে পুলিশের একজন এডিসি ছিলেন। ওই এডিসিকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচয় দেন। ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট তখন সরি বলেছিল কবিরকে।
২৫ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর পান ওই তরুণী। বিশ্বাস করেননি শুরুতে। যদিও খবর শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ওই তরুণীর সঙ্গে যৌথ ছবি দেখে সোহেল নামে একজন জানতে চান, এই ব্যক্তি আপনার কি হন। পরিচয় পেয়ে সোহেল তাকে কয়েকটি ছবি সেন্ট করেন। তিনি জানান, তার মামাতো বোনের সঙ্গে ২২ জুলাই বিয়ে হয়েছে হুমায়ুন কবির মাসুদ নামে এই ব্যক্তির। তাকে পুলিশের এএসপি হিসেবে জানেন তারা।
এ বিষয়ে গাজীপুরের টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার শাহ্ আলম জানান, এএসপি পরিচয় দিয়ে তার আত্মীয়ের মেয়েকে বিয়ে করেছে এই প্রতারক। বিমানবন্দর এলাকায় তার রেন্ট-এ কারের ব্যবসা রয়েছে। রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ী শাহজাহান, নূর ইসলামের মাধ্যমে তাকে চিনেন তারা। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও তাকে স্যার বলে সম্বোধন করেন যে কারণে তাদের কোনো সন্দেহ হয়নি। বিষয়টি প্রতারণার শিকার দুই তরুণীর পরিবারের মধ্যে জানাজানির পর ১ আগস্ট বড় মগবাজারের ডাক্তার গলির বাসায় গেলে কবিরকে গ্রেফদার করে রমনা থানা পুলিশ। এ ঘটনায় তরুণী বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন।
এ ঘটনার প্রকাশ্যে আসার পর পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই যেন অবাক। কিভাবে একটা মানুষ এভাবে দিনের পর দিন প্রশাসনের দোহাই দিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে, সেটা নিয়ে এখন চারদিকে চলছে তোলপাড়।
মামলার তদন্তকারী উপ-পরিদর্শক শেখ মেহেদী হাসান বলেন, তিনদিনের জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার বিষয় সে স্বীকার করেছে। পুলিশের অনেক সদস্যকেও সে এসব পরিচয় দিতো। কবির খুবই চালাক প্রতারক। যে কারণে সহজে কোথাও ধরা পড়েনি। সে দেশে থেকেই ফোনে কথা বলে জানাতো বিদেশে আছে। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি। আসাদুজ্জামান মামুন নামে তার একটি মোটরড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। একাধিক গাড়ি ও বিভিন্ন ব্যাংকে তার একাউন্ট রয়েছে।
হুমায়ুন কবির মাহমুদ আলম কবির ওরফে মাসুদের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার হামিরাবাগ গ্রামে। তার পিতার নাম আবদুল জব্বার লতু মিয়া। সূত্র: মানবজমিন
বিডি-প্রতিদিন/২০ আগস্ট, ২০১৬/মাহবুব