পাখিরাই বদলে দিয়েছে এই গ্রামের নাম। কাগজে কলমে লিখলেও এই গ্রামের আসল নাম ভুলে গিয়ে সবাই এখন পাখিনাগা বলেই ডাকে । হাজার হাজার পাখি বিচরণের কারণে ঐ গ্রামের নাগরিকরা তাদের গ্রামটিকে পাখিনাগা বলেই সম্বোধন করেন। ঠিক কতো বছর আগে থেকে এই গ্রামে পাখিরা তাদের আবাসস্থল বানিয়েছে এরকম প্রশ্নের উত্তরে গ্রামের অনেকেই বলেছেন, 'বাপ দাদার আমল থেকে দেখে আসছি'।
পঞ্চগড় থেকে ৪০ কিলোমিটার দুরে দেবীগঞ্জ-ডোমার উপজেলা সীমান্ত রেখার গ্রাম পশ্চিম ডাঙ্গাপাড়া। ভাওলাগঞ্জ-চিলাহাটি সড়ক থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় তিন কিলোমিটার আঁকা বাঁকা কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে এই গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে আকাশে উড়াউড়ি করছে হাজার হাজার পাখি। গ্রামের পূর্ব দিকের শেষ প্রান্তে প্রায় দুই একর বাঁশ ঝাড় ঘিরেই পাখিরা গড়ে তুলেছে তাদের নিরাপদ আবাস। বাঁশ ঝাড়ের মালিক মজিদুল ইসলাম শেখ সাহেবের বাড়িও বাঁশ ঝাড়ের নিচেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মেছিল বলে আদর করে সবাই তাকে শেখ সাহেব নামে ডাকেন।
দুপুরবেলা পাখিদের এই গ্রামে গিয়ে দেখা যায় বাঁশ পাতার আড়ালে আবডালে বাচ্চা আর কিছু সংখ্যক বড় পাখি বাসায় বসে কিচির মিচির করছে। বাড়ির মালিক মজিদুল ইসলাম শেখ সাহেব জানালেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কারণ এখন সবাই চলে গেছে খাবারের সন্ধানে। বিকেল থেকে তারা ফেরা শুরু করবে। প্রখর রোদে মাটিও গরম হয়ে গেছে তখন। কিন্তু কি আর করা। এতদূর এসে পাখি না দেখে ফিরে গেলে আক্ষেপ থেকে যাবে। সন্ধ্যার অপেক্ষা করতে থাকলাম সে বাড়িতেই। এর মধ্যে এই কলোনীর ইতিহাস আর অন্যান্য প্রসঙ্গে আলোচনা করে নিলাম গ্রামবাসীদের সাথে।
বাড়ির মালিক শেখ সাহেব জানান, ‘পাখির এই কলোনীর ইতিহাস সম্ভবত দুই শত বছরের হবে। কারণ আমার দাদু বলত তিনি তার দাদুর কাছেও পাখিদের এই কলোনী শুরুর কথা জানতে পারেননি। স্বাধীনতার আগে নিলফামারী থানার এক সুবেদার এখানে পাখি শিকার করতে এসেছিল। শুনেছি আমার দাদুর বাবা তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। রায়ও পেয়েছিলেন। হাজার হাজার পাখি এখানে থাকলেও এই গ্রামের কেউ পাখিদেরকে শিকার করেনা।’
এই গ্রামের অধিবাসী আমিনুল ইসলাম জানান, ‘অক্টোবরের শুরু থেকেই বড় পাখিরা চলে যায়। আবার বৈশাখের শুরুতেই তারা আসতে শুরু করে । বছরের এই কয়েকমাস তারা এখানেই থাকে । প্রজনন আর শিশু পাখি লালন পালনের জন্য নিরাপদ বলে পাখিরা এখানে থাকে । এই কয়েক মাসে তারা বেশ কয়েকবার প্রজনন ঘটায়। এরপর বাচ্চারা উড়তে শিখলেই তারা চলে যায়। প্রজনন শেষ হলে পাখিরা বাচ্চাদের উড়তে শেখায়। এসময় কিছু বাচ্চা মাটিতে পড়ে যায় । তখন আমরা তাদেরকে উপড়ে বাসায় তুলেদেই’।
চিলাহাটি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী রেমী আক্তার জানান, ‘পাখির কিচির মিচির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। রাত বারটায় পাখিরা ডেকে উঠে। তখন আমরা ঘুমাতে যাই। এরপর রাত তিন টার দিকে একবার ঝাঁক বেধে কিচির মিচির করে উঠে। খুব ভাল লাগে আমাদের।’
বেলা পড়ে এসেছে । পাখিরা ফিরতে শুরু করেছে । মাথার উপড়ে তখন হাজার হাজার পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে । পাখিরা উড়ে এসে বাঁশ ঝাড়ে বসছে । তারা বাচ্চাদের মুখে আহার তুলে দিচ্ছে। কেউ কেউ সন্তানদের আদর করে দিচ্ছে । অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারনা হয় তখন। দেখা যায় বক, পানকৌড়ি, রাতচড়া, ঘুঘু, শ্যামা, দোয়েল, শালিক, বাবুই, চুড়ই এমন নানা ধরনের পাখির কলতানে তখন মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গোধুলীর আলোর সাথে পাখির কলতান মিলিয়ে যাচ্ছে। এসময় পাখির এই কলোনীটি কত দিন টিকে থাকবে তা নিয়ে শংকার কথা জানালেন বাড়ির মালিক মজিদুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘বাঁশ ঝাড় কমে যাচ্ছে। অর্থের অভাবে বাঁশ ঝাড়ে নতুন মাটি দেয়া যাচ্ছেনা। তাই নতুন বাঁশও হচ্ছেনা। পাখিদের খাবার কমে যাচ্ছে। আশে পাশে পুকুর নেই। সরকারি উদ্যোগ নেয়া হলে টিকে থাকতে পারে পাখিদের এই গ্রাম।’
বিডি প্রতিদিন/২৮ আগস্ট ২০১৬/হিমেল-০৯