ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস (৩ ডিসেম্বর)। ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। পঞ্চগড়ের ৫ থানা ছিল ঠাকুরগাঁও মহকুমার অধীনে। এই এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাস থেকে।
সেপ্টেম্বর’৭১ মাসের ৭ তারিখে পঞ্চগড়ের জগদলহাট আক্রমণের মধ্যে দিয়ে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযান শুরু হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে চাওয়াই নদী পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যতই অগ্রসর হচ্ছিলো পাকিস্তানি বাহিনী ততই ভীত হয়ে পিছু হটছিল। এক সময় মূল সড়ক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে এসে পড়ে এবং নভেম্বর মাসের ২১ তারিখ থেকে পুরোদমে আক্রমণ ও অগ্রাভিযান শুরু হয়। ২২ নভেম্বর তারিখে ১২ রাজপুতনা রাইফেলস রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানির সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে হামলা ও অগ্রাভিযানে অংশ নেয়। ওদিন ৮২টি ভারতীয় ট্যাংক এসে তেঁতুলিয়া বন্দরের বিভিন্ন স্থানে পজিশন নেয় এবং এর সাথে ভারতীয় ৭ মারাঠা রেজিমেন্ট অবস্থান গ্রহণ করে।
একাত্তরের ২৩ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের রাতেই সম্মিলিত বাহিনী অমরখানা ও জগদল দখল করে নেয়।
পঞ্চগড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মজবুত খাঁটি ছিল। এখানে তাদের তিন ব্যাটালিয়ন সৈন্য অবস্থান করতো। মূল সড়কের উভয় পাশেই ছিল পাকা বাংকার ও মজবুত ট্রেঞ্চ (পরিখা)। ২৬ নভেম্বর তারিখে মুক্তিবাহিনীর এক ব্যাটলিয়ন ও ভারতীয় রাইফেলস রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য যৌথভাবে পঞ্চগড় আক্রমণ করে। কিন্তু এখানে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ১০০ জন ও মুক্তিযোদ্ধাদের ২২ জন হতাহত হয়।
২৭ নভেম্বর সারাদিনব্যাপী উভয় পক্ষ তাদের নিজ অবস্থান থেকে তুমুল গোলাগুলি বর্ষণ করে। এদিন বিকেল থেকেই শুরু হয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণ।
২৮ তারিখ রাতে ভারতীয় মারাঠা রেজিমেন্টের তিন ব্যাটালিয়ন সৈন্য ও ভারতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্ট ৬০টি গান থেকে শেলিং শুরু করে। এ রাতে প্রায় ৬ হাজার গোলা বর্ষণ করা হয় পাকিস্তানি সেনাদের শক্ত ডিফেন্সের উপর। ফলে পাকিস্তানি সেনারা পর্যুদস্ত হয়ে পঞ্চগড় থেকে পিছু হটে ময়দানদিঘিতে ডিফেন্স নেয়। এ রাতে সম্মিলিত বাহিনীর প্রায় ২৫ জন এবং পাকিস্তানি সেনাদের ২৫০ জনের মত হতাহত হয়। প্রচুর গোলাবারুদ ও ৮টি গাড়ি রেখে পাকিস্তানি সেনারা পঞ্চগড় থেকে তাদের ডিফেন্স তুলে নিতে বাধ্য হয়।
সম্মিলিত মিত্র বাহিনী ৩০ তারিখে বোদা এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের পরবর্তী ডিফেন্সের উপর হামলা চালায়। ভারতীয় আর্টিলারীর ক্যাপ্টেন সুধীর এখানে নিহত হন। ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখে বোদা থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং সম্মিলিত মিত্র বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। ভারতীয় বাহিনী বোদাতে এসে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী বীরবিক্রমে ঠাকুরগাঁওয়ে দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঠাকুরগাঁওয়ের অদূরে ভুল্লণ্ডীর কাছে আবারও মুক্তিবাহিনী বাধাগ্রস্ত হয়। সেখানে ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর তোপের মুখে টিকতে না পেরে ভল্লণ্ডী ব্রিজ মাইন দিয়ে উড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছনে হটতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সৈন্য এই ব্রিজ মেরামত করে ফেলে রাতারাতি।
ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরের শক্ত ডিফেন্স ও তাদের রিয়ার হেড কোয়ার্টার ইপিআর ক্যাম্পের ঘাঁটি ছেড়ে বীরগঞ্জের দিকে পিছু হটতে থাকে এবং ভাতগাঁও পুলের কাছে তাদের ডিফেন্স নেয়। তার আগে ২ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী ইপিআর ক্যাম্পের সামনের রামদাড়া পুলের ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। সকালে সম্মিলিত বাহিনী ব্রিজের পাশ দিয়ে রাস্তা করে সমরাস্ত্র নিয়ে পার হয়। গেরিলারা ২ ডিসেম্বর রাতেই ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে। তারা গড়েয়া রাস্তা দিয়েও অগ্রসর হয়। পরদিন সম্মিলিত বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট একটা দল ৩ তারিখে সকালে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে উল্লাস করতে থাকে। সকালে শহরের চৌরাস্তায় বিজয় পতাকাও উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী।
বালিয়াডাঙ্গী ও আখানগর দিয়ে মুক্তিবাহিনীর অপর একটি দলও আক্রমণ চালিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে আসে। তাদের সম্মিলিত দল ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে এসে হাজির হয় এবং দিনভর বিজয় পতাকা উড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে। জেলার হরিপুর ও রাণীশংকৈল উপজেলাও মুক্ত হয় একই দিনে। কোচল, ভাতুরিয়া, ডাবরী, চাপসা, জগদল, কাঠালডাঙ্গী বর্ডার দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী গোলা বর্ষণ করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে।
ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবসে উদীচী ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যৌথভাবে র্যালি, সমাবেশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
বিডি প্রতিদিন/ ০২ ডিসেম্বর ২০১৬/ এনায়েত করিম