ইয়াবা এখন আর সুদূর মিয়ানমার থেকে আসছে না, ইট পাথরের এই নগরীতেই গড়ে উঠেছে ইয়াবার কারখানা। চাহিদামাফিক তৈরি হচ্ছে এই মাদকদ্রব্য। ফলে আট থেকে দশ ধরনের ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে নগরীর আনাচে কানাচে। প্রায় প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইয়াবার জমজমাট ব্যবসা চলছে।
শুধু যুবসমাজ নয়, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে মুদি দোকানদার যে কেউ ইয়াবা সেবনের দিকে ঝুঁকছে খুব সহজেই। বৃহস্পতিবার সকালে আশুলিয়ার সাধুপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে মদ তৈরীর কারখানার ও বিপুল পরিমান মদ তৈরীর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
এলাকাবাসী জানায়, সাধুপাড়া এলাকার সুলতান মিয়া (৫০) দীর্ঘ দিন ধরে ওই এলাকায় মদ তৈরি এবং বিক্রি করে আসছিলো। এদিকে ফোনের মাধ্যমে ইয়াবার জমজমাট ব্যবসা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আশির দশকে দেশে হেরোইন ভয়াবহভাবে ছড়িয়েছিল। পরবর্তীতে মিয়ানমার হয়ে আশির দশকে ইয়াবা ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে।
সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন বস্তিকে ঘিরে হেরোইন, গাঁজা, ফেন্সিডিলের রমরমা হাট বসেছিল। এখন ইয়াবার সুবাদে মাদক বস্তির পাশাপাশি অভিজাত পাড়ার স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সাইবার ক্যাফে, ফাস্ট ফুড শপ, সেলুন, কফি হাউজসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে গড়ে উঠছে ইয়াবার আগ্রাসন। এখন ইয়াবার দাম ও চাহিদা দুটোই বেশি। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে ৮৬ লাখ মাদক সেবীর মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, গৃহবধূ এবং মডেল ও নাট্যকর্মীরা আসক্ত হচ্ছেন ইয়াবায়। ঢাকা জেলাসহ দেশের অভিজাত এলাকাগুলোতে স্ট্যাডি সার্কেলের মতো গড়ে উঠেছে ইয়াবা সার্কেল। উঠতি মডেল ও নগরীর প্রতিষ্ঠিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়াবা সেবনের কথা জানান। তাদের মতে ‘চেজিং দ্য ড্রাগন ’ পদ্ধতি কিংবা সিরিঞ্জের মাধ্যমে সরাসরি শরীরে প্রবেশ করানোটা ক্ষতিকর। তাই তারা কফির সাথে গুলিয়ে ইয়াবা সেবন করেন। মোবাইল ফোনে তারা বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করেন।
আশুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন মাদবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইয়াবা হিরোইন দেশী বিদেশী মাদকের ব্যাপক চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে একটি প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সাভার ও আশুলিয়ার দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করে আসছে নকল ইয়াবা, তিনি আরো বলেন নব্বই দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও তখন বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। এখন শুধু সাভার আশুলিয়ার নয়, গোটা দেশ ইয়াবায় ভাসছে। সাভারের বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাড়িতে খুলে বসছে ইয়াবার কারখানা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চল অভিযান চালিয়ে নকল ইয়াবা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ ইয়াবা তৈরির বেশ কিছু উপাদান পেয়েছিল।
এর মধ্যে ছিল নকল ইয়াবা ২ হাজার ২শ' ৫০টি, ইয়াবা তৈরির উপকরণ এমফিটামিন পাউডার ৭শ' ৩০ গ্রাম, বিভিন্ন রং ৩ প্যাকেট, বিভিন্ন ফ্লেভার ২০ শিশি ও ইয়াবা তৈরির ডায়াস (গুটি)। ফেনন্সিডিল ও ইয়াবা ব্যবসায়ী আতিকউল্লাহ আতিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ধনী গরীব যে কেউ চাইলেই যাতে ইয়াবা সেবন করতে পারে, তার জন্যই ভেজাল ইয়াবা তৈরি বেড়েছে। ইয়াবার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে টেকনাফ এলাকায় আট থেকে দশ ধরনের ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে নিম্নমানের দেশীয় ইয়াবা ‘চম্পা’র দাম পড়ছে দেড়শ টাকা, চম্পা সুপার বিক্রি হচ্ছে দুইশ টাকায়। 'আর' নামের তিন ধরনের ইয়াবার সন্ধানও পাওয়া গেছে। এরমধ্যে রয়েছে আর-৭০, আর-৮০ ও আর-৯০। এগুলোর দাম পড়ছে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা। জিপি ও এন সিরিজের ইয়াবা সবচেয়ে দামি। খুচরো বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে সাড়ে সাতশ টাকায়। এছাড়া ডবু ওয়াই নাম একটি ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকায়। যুবসমাজই শুধু নয়, মুদি দোকানি থেকে মাছ বিক্রেতার সন্ধান পাওয়া গেছে যারা মূল পেশার আড়ালে ইয়াবার খুচরো বিক্রেতা হিসেবে কাজ করছে। এর ফলে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ইয়াবা সেবন করতে পারছে মাদকাসক্ত।
সাভার মডেল থানার সার্কেল এএসপি মাহাবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ধামরাইয়ে ৮৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার মধ্যরাতে পৌরসভার বড় চন্দ্রা এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়।
সিআইডির ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা যায়, এসব ভেজাল ইয়াবায় আসল ইয়াবার কোন উপাদানই নেই। যেসব উপাদান দিয়ে ভেজাল ইয়াবা তৈরী হচ্ছে, সেসব উপাদান মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ধরনের মাদক সেবনে দ্রত কিডনি বিকল, মস্তিষ্কের নার্ভের কার্যক্ষমতা হ্রাস, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত, শ্বাসনালীতে ক্ষত এবং ফুসফুসে ছিদ্র হওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চলের পরিদর্শক আতাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নকল ইয়াবা সেবনে নেশা গ্রস্ত হওয়ার চেয়েও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। যুব সমাজ ইয়বা সেবনে যেমন বিপথে যাচ্ছে তেমনি বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রিত নকল ইয়াবা সেবন করে নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনছেন।
বিডি প্রতিদিন/২ মার্চ ২০১৭/হিমেল