'ঋণ নয়, অসহায় ভূমিহীনদের সরকারি অনুদানের টাকা'-এমন প্রলোভনে সোনালী ব্যাংকের দালাল চক্রের ফাঁদে পরে বিপাকে পড়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের সাঁওতাল সম্প্রদায় জনগোষ্ঠীসহ শতাধিক পরিবার।ঋণের টাকা পরিশোধের নোটিশ পেয়ে এখন কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আবার কেউ হতাশ হয়ে জ্ঞান হারাচ্ছেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের শতাধিক আদিবাসী ভূমিহীন ও দুস্থদের নামে রোড সুগারমিল সোনালী ব্যাংক শাখা থেকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা কৃষিঋণ তুলে আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংক থেকে উক্ত কৃষিঋণ পরিশোধের নোটিশ আদিবাসী ভূমিহীন ও দুস্থদের কাছে গেলে বুঝতে পারে প্রতারিত হয়েছে তারা।
শতাধিক আদিবাসী ভূমিহীন ও দুস্থদের ভুল বুঝিয়ে সরকারি অনুদান দেয়ার কথা বলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মোহাম্মদপুর এলাকার তরিকুল ও সোলেমান নামে দুই ব্যক্তি এ ভয়াবহ প্রতারণা করেন এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাতৃগাঁও ওয়ার্ডের আদিবাসী হাউয়া মরমু নামের এক আদিবাসী মহিলার সাথে কথা বলে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও সোনালী ব্যাংক রোড সুগার মিলস্ শাখা হতে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে আমন ফসল উৎপাদনের জন্য ২৫ হাজার টাকা কৃষি ঋণ গ্রহন করে সে। কিন্তু হাউয়া মরমু এ সম্পর্কে কিছু জানে না। তাকে শুধু সরকারী অনুদানের ২ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে সে এটাই জানে।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই ঋণের জন্য সুদসহ ৩১ হাজার ৪শ ৪১ টাকা পরিশোধ করার জন্য তাকে কিছুদিন আগে নোটিশ করেছেন। অন্যের জমিতে ঘর করে যেখানে তাদের উদবাস্তু জীবন। দু’ছেলে মেয়ের মুখে অন্ন যোগাতে হাড়ভাঙ্গা খাটুনী আজ ঋনের বোঝায় কাতর হয়ে রোগে শোকে মুষড়ে পরেছে পরিবারটি।
তখন সে দিশেহারা হয়ে আশেপাশের সকলের কাছে খোজঁখবর নিয়ে জানতে পারেন তার মতো সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০টি পরিবারসহ ওই গ্রামের ভূমিহীন ও অসহায় শতাধিক পরিবার গুলোর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তরিকুল ও সোলেমান তাদেরকে প্রতারিত করেছে।
এখন এসব নিরীহ দরিদ্র মানুষগুলো চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ঋণ থেকে মুক্তি পেতে তারা এখন স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য লোকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন প্রতিদিন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ভুক্তভোগীরা সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাতৃগাঁও গ্রামের ব্যাংকের দালাল হিসেবে পরিচিত তরিকুল ও সোলেমান নামে দুই ব্যক্তি কৌশলে সোনালী ব্যাংক রোড সুগারমিল শাখা থেকে ২০১৪-১৫ সালের অর্থ বছরে আমন ধান উৎপাদনের জন্য কৃষি ঋনের নাম করে আদিবাসী ভূমিহীন ও দুস্থ শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ভোটার আইডি, ছবি নেয়। আদিবাসী ভূমিহীন ও দুস্থদের নামে কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংকে কৃষিঋন নবায়ন করেন তারা।
এর আগে সরকারি অনুদান পাইয়ে দেয়ার কথা বলে আদিবাসী ভূমিহীন ও দুস্থদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি ও টিপসই সংগ্রহ করেন তরিকুল ও সোলেমান। এরপর ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে তাদের প্রত্যেকের নামে ২০ থেকে ৩২ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন তারা। আর ওই আদিবাসী ভূমিহীন ও দুস্থদের ২/৩ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদানের টাকা ধরিয়ে দেন।
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তরিকুল ও সোলেমান গা-ঢাকা দেয়। অনেক চেষ্টা করার পর ওই দুই প্রতারকের সাথে কথা হলে অভিযোগ স্বীকার করে বলছেন, ঋণ পরিশোধ করতে হবেনা বলেই গ্রাহক সংগ্রহ করতে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আর গ্রাহক আনলেই তাদের দেয়া হতো দিনের পারিশ্রমিকের টাকা। আর এ ঘটনা তদন্ত করলে বেড়িয়ে আসবে অনেক রাঘব বোয়াল বলে মনে করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান।
মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সোহাগ বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের কাগজ পাওয়ার পরে সকলে আমাকে অভিযোগ করেছে। আমি লিখিত ভাবে অভিযোগ নিয়েছি। সবার অভিযোগ একখানে করার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো। প্রশাসক দ্রুত ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে ভূমিহীন অসহায় পরিবার গুলোকে দায় মুক্তি দেবে এমন দাবি সবার।
অনিয়মের বিষয়ে সোনালী ব্যাংক ঠাকুরগাঁও রোড সুগার মিল শাখার ম্যানেজার রেজাউল করিম পি.ও জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ায় গ্রহীতাদের নোটিশ করা হয়েছে। বর্তমানে এ শাখা দালাল মুক্ত বলে দাবি করেন তিনি। ঋণ গ্রহীতার কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই করার পর ঋণ বিতরণ করা হয়। কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল জানান, আমরা তাদের পাশে সবসময় আছি। প্রতারক চক্রকে সনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংকের সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধানের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
বিডিপ্রতিদিন/ ১৫ নভেম্বর, ২০১৭/ ই জাহান