দীর্ঘদিন ধরে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীদের নামাজে জানাজা হতো না। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হলেও এতদিন জানাজা নামাজ ছাড়াই তাদের সৎকার হয়েছে। মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো কিংবা মাটিতে দাফন। এটাই প্রথা ও সামাজিক রীতি হিসেবে যেন মেনে নিয়েছে সবাই। সেই প্রথাটাই ভাঙলেন গোয়ালন্দঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান। সম্প্রতি জানাজা পেলেন দৌলতদিয়ার প্রবীণ যৌনকর্মী হামিদা বেগম। ৬৫ বছর বয়সী এই নারীর লাশ ২ ফেব্রুয়ারি রাতে নামাজে জানাজার পর দাফন করা হয়। আর এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে স্থানীয় থানা পুলিশ। জানাজা শেষে পরিচিত কোনো যৌনকর্মীর লাশ দাফনের ঘটনা দেশে হয়তো এটাই প্রথম।
সম্প্রতি গোয়ালন্দ ঘাট থানায় যোগ দেন আশিকুর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সবারই ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করা উচিত। আমরা যতই পাপী হই না কেন, বিচার করার মালিক একজন (আল্লাহ)। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এবং মুসলমান হিসেবে নিজ দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে হামিদা বেগমের নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করেছি। আগামীতেও এটি অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, আগে কোনো যৌনকর্মীর মৃত্যু হলে অমানবিকভাবে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হতো বা মাটিচাপা দেওয়া হতো। কেন এমন করা হতো? যৌনকর্মীদের মৃত্যু হলে কেউ জানাজা পড়াতে রাজি হতেন না। কিন্তু ইসলামে তো এটাও নেই যে, পাপী ব্যক্তির জানাজা পড়ানো যাবে না। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মাসআলা জানতে চাইলে একজন আলেম অনেকটা বাধ্য হয়েই জানাজা পড়াতে রাজি হন। রাতে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। কাজটি সফলভাবে করতে পেরে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করছি।
ওসি বলেন, যৌনকর্মী শব্দটি ভদ্র ও সভ্য সমাজে একটি ঘৃণিত পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এদের সৃষ্টি করেছেন সমাজের মুখোশধারী ও ভদ্রবেশীরা। তবে কেন তারা ধর্মীয় সম্মান পাবে না? তারা তো এ দেশেরই নাগরিক।
সমাজের চোখে সাধারণভাবে অসম্মানিত হলেও পৃথিবীতে পতিতাবৃত্তি আজও টিকে আছে। নানা ছলচাতুরি, কখনও ফাঁদে পড়ে কখনও বা অভাবের ফলে এই পথে নামে নারী। তবে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে সম্প্রতি বিভিন্ন অপরাধ ও জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার বিরুদ্ধে পুলিশ কড়া নজরদারি রাখছে। এরই ধারাবাহিকতায় সেখানে মাদক, জোরপূর্বক দেহব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পল্লীর বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়মিত বসেন গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশ।
এরই অংশ হিসেবে ২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে যৌনকর্মীদের ‘অবহেলিত নারী ঐক্য’ নামের সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় হামিদা বেগমের মৃত্যুর খবর আসে। ওই সময় পল্লীর বাসিন্দারা জানাজাসহ হামিদার লাশ দাফনের দাবি তোলেন। গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আশিকুর রহমান এই দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ওই নারীর জানাজা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন। রাত ৯টার দিকে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। থানার ওসি ছাড়াও দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মন্ডল, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল জলিল ফকীরসহ স্থানীয় অনেকে জানাজায় অংশ নেন। জানাজা নামাজে ইমামতি করেন দৌলতদিয়া রেল মসজিদের ইমাম গোলাম মোস্তফা।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল জলিল ফকীর সাংবাদিকদের জানান, অতীতে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর কোনো বাসিন্দা মারা গেলে জানাজা হতো না। আসল কথা হলো, কেউ জানাজা নামাজ পড়াতে রাজিই হতেন না। তাই বাধ্য হয়ে মৃত ব্যক্তিকে মাটিচাপা দেওয়া হতো। গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি সাহেবের উদ্যোগে জানাজা এবং ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী প্রথমবারের মতো কোনো যৌনকর্মীর লাশ দাফন হলো।
সহস্রাধিক যৌনকর্মীসহ দেশের বৃহত্তম এ যৌনপল্লীতে প্রায় আড়াই হাজার বাসিন্দার বসবাস। এখানকার বাসিন্দাদের কারও মৃত্যু হলে এক সময় নদীতে মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হতো। তবে কয়েক বছর আগে পল্লীর পাশে একটি কবরস্থান করা হয়। সেখানে জানাজা ও দাফন ছাড়াই লাশ মাটিচাপা দেওয়া হতো।
বিডি প্রতিদিন/আল আমীন