বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এমনকি দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ চরম হিমশিম খাচ্ছে। দেশের এই বিপদের সময় যেখানে এমবিবিএস ডাক্তাররা মানুষের সেবা দিবেন, সেখানে এমবিবিএস ডাক্তাররা তাদের নিরাপত্তা ও ভয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে না। একমাত্র গ্রাম ডাক্তাররাই নিজেদের ঝুঁকি নিয়েই চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
মাদারীপুরে বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না অভিযোগ সাধারণ রোগীর।
সরেজমিনে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার চিড়াইপাড়া গ্রামের হালিমা বলেন, ‘বাবুর ঠান্ডা-কাঁশি। আসছিলাম শিশু ডাক্তার দেখাইতে, দুইদিন আইসা ফিররা গেছি। পরে বাড়ির পাশে আমাগো কাকারে (গ্রাম ডাক্তার) দেখাইছি। এখন বাবু ভাল হইয়া গেছে’।
এদিকে, স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার কুন্তিপাড়া গ্রামের হাওয়া বেগম বলেন, আমি বাসার থেকে বের হয়েছি, কোন রিকশা নেই। আমার বাড়ির পাশের রিকশাওয়ালাকে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধা ও রিকশার চাবি নিয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ ১ ঘণ্টার রোদ্রে রোগী নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। গিয়ে কোনো ডাক্তার পাই নাই। পরে রোগী ক্রমান্বয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়েই গেলাম পরিচিত গ্রাম ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নেই’।
কালাকিনি উপজেলার ভুরঘাটা এলাকার গ্রাম ডাক্তার সুকুর মাহমুদ সুজন বলেন, ‘আমার একটি জীবনের বিনিময়ে যদি এদেশের হাজারো মানুষের জীবন বেঁচে যায় তাহলে আমি হাজারো মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবো। আমি মনে করি একজন আদর্শবান ডাক্তার কখনও তার সেবা থেকে সরে থাকতে পারে না, আমি দেশবাসী সকলের কাছে দোয়া চাই, যেন আপনাদের সকলের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারি যেকোনো মহামারী ও দুর্যোগ মোকাবেলায় আপনাদের পাশে থাকবো ইনশাআল্লাহ।
শহরের বাদামতলা এলাকার গ্রাম ডাক্তার বাপ্পী সরকার বলেন, ‘আমরা অনেক ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। একদিকে করোনার ভয় অন্যদিকে বড় ডাক্তারদের হুমকি ধামকি।
তিনি আরও বলেন, ‘এমবিবিএস ডাক্তার না পেয়ে নিরুপায় হয়ে আমাদের কাছে অনেক অসহায় রোগী আসে। আমরা যতদূর সম্ভব চিকিৎসা সেবা দিই’।
পেটে ব্যথা নিয়ে আসা বাদামতলা এলাকার তানিয়া আক্তার বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো ডাক্তার পাইনি কোনো হাসপাতালে, এক ডাক্তারকে ফোন করেছি সে ৩০০০ টাকা চেয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে গ্রাম ডাক্তার বাপ্পী সরকারের কাছে আসছি। ওনার চিকিৎসায় আমি এখন ভাল।
রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট এলাকার গ্রাম ডাক্তার পরেশ মন্ডল বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তার কম থাকায়; গ্রাম ডাক্তারদের কাছে রোগীরা বেশি আসছে। তবে আমি স্বাস্থ্য বিধি মেনে চিকিৎসা দিচ্ছি এমনকি ফোনেও দিচ্ছি।
মাদারীপুর শহরের কলেজ রোড এলাকার গ্রাম ডাক্তার আলী আজম সরদার জানান, করোনাভাইরাসের ফলে যানবাহান চলাচল না করায় অনেক রোগী আসতে পারছে না। আগের চেয়ে রোগীর চাপ বেশি। জরুরি প্রয়োজনে রোগীদের আসতে বলি এবং তাদেরকে মোবাইলে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি এবং নিজে সচেতন থেকে ও স্বাস্থ বিধি মেনে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ গ্রাম ডাক্তার কল্যাণ সমিতির মাদারীপুর জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. জুয়েল বেপারী জানান, ‘মাদারীপুর জেলায় ৭৫০ জন গ্রাম ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আমার গ্রাম ডাক্তার ভাইরা এই দুর্যোগকালীন মুহূর্তে দেশের মানুষকে সেবা করছে। তারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, সবাই আমার সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছে, আমার পক্ষে তাদের জন্য সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই নেই। রোগীরা আপনার কাছে যতদ্রুত আসতে পারবে বড় ডাক্তারের কাছে তত দ্রুত আসতে পারবে না। এর মধ্যে পুলিশের ভয়ে আসে না। এই দুর্যোগকালীন সময়ে দেশের পাশে থাকলে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই আপনাদের পাশে সহযোগিতা করবে। দেশের এই ক্রান্তিকালে মানুষের সেবায় নিয়োজিত একমাত্র গ্রাম ডাক্তার’।
মাদারীপুর সিভিল সার্জন ডা. মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, যারা গ্রাম ডাক্তার রয়েছেন, তারা যে প্রাথমিক সেবাটি দিচ্ছেন আমি সেটাকে মন্দ বলবো না; তবে তারা যেন নিজেকে সুরক্ষিত রেখে সেবা দেন। আর যতদূর সম্ভব টেলিমেডিসিন পদ্ধতি ব্যবহার করে মোবাইলের মাধ্যমে সেবা দেন। এতে করোনা ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন