ইফতারির আয়োজন ছাড়াও পারিবারিক, বন্ধু-বান্ধব, সামাজিক আড্ডা ও অতিথি আপ্যায়নে মুড়ির ব্যবহার এখনো বাঙালি রসনা সংস্কৃতিতে সিংহভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে। গ্রামাঞ্চলে এর জুড়ি নেই। আর সেটা যদি হয় হাতে ভাজা মুড়ি, তবে তা স্বাদে অনন্যতা সৃষ্টি করবেই।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বারতোপা, জৈনাতলীর পার্শ্ববর্তী গ্রাম বগারপুর, বহেরাতলী এলাকায় সারা বছরই হাতে মুড়ি ভাজা হয়। হাতে মুড়ি ভেজে ওইসব গ্রামের প্রায় ৩০টি পরিবার জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব গ্রামে হাজার হাজার মণ ধানের মুড়ি ভাজা হয় প্রতি বছর। এর চাহিদা রমজান মাসে বেশি থাকে। বাণিজ্যিকভাবে বিচ্ছিন্নভাবে আরও কয়েকটি গ্রামে হাতে মুড়ি ভাজা হয়।
বগারপুর পাড়ার মৃত কেরামত আলীর স্ত্রী মুড়ি শ্রমিক রূপজান (৬৫) বলেন, যে শ্রমিক ভাজা চাল গরম বালিতে মেশান তার মজুরি ৫০০ টাকা। অন্যান্য সহযোগীদের ৪০০ টাকা করে দেওয়া হয়। মুড়ি শ্রমিক শাহিদা খাতুন (৩৮) জানান, উদ্যোক্তা আর শ্রমিকদের মধ্যে সমন্বয় আছে। আমরা কষ্ট করে প্রতি সাড়ে ৫০০ মণের বিপরীতে ওই পরিমাণ পারিশ্রমিক পাই।
এতে দেখা যায়, ধান ভাঙানো বাদে একেকজন গড়ে ৫০০ টাকা মজুরি পান। যা উদ্যোক্তাসহ পাঁচজন শ্রমিকের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। শ্রমিক বেশি হলে মজুরি কমে আসে এবং সময় কম লাগে। নিজেরা ধান কিনে মুড়ি ভাজতে পারলে ভালো লাভ পাওয়া যেত। কিন্তু মূলধন না থাকায় এলাকার অর্ডার সরবরাহকারী ও বেপারীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ভোক্তা পর্যন্ত মুড়ি পৌঁছাতে মাঝখানে চারজনের হাত বদল হয় বলে জানান তিনি।
মৃত সাইজ উদ্দিনের স্ত্রী উদ্যোক্তা কমলা খাতুন (৪৫) বলেন, বেপরীরা ধান দেয়। প্রথম দিন গরম পনি করে ফেলতে হয়। তারপর সেদ্ধ, শুকানো ও ভাঙাতে হয়। আমরা ৩ হাজার থেকে ৩২০০ টাকা পারিশ্রমিক পাই। ১১ মণ ধানের মুড়িতে ১০ কেজি লবণ ব্যবহার করি। রমজানের ১৫ দিন আগে থেকে ১৫ রমজান পর্যন্ত মুড়ি বেশি আর্ডার পাওয়া যায়। তখন চাহিদা বেশি থাকে।
তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো চালান নাই। মুড়ি ভাজতে ভাল লাভ পাওয়া যায় না। এলাকায় সুলভ মূল্যে লাকড়ি পাওয়া যায়। তাছাড়া আমরা মুড়ি ভাজার কাজটা ভাল জানি। তাই এ পেশায় লেগে আছি। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়ে কল-কাখানায় চাকরি করছে। সরকার যদি কিছু সাহায্য করত, তাহলে নিজেরাই ধান কিনে মুড়ি ভেজে বাজারজাত করতে পারতাম। এখন ধানের দাম বেশি। ধানের দাম কম হলে লাভ ভাল হতো।
উদ্যোক্তারা জানান, ইরি ও শাইল আবাদের সময় নাটোর ও বরিশাল থেকে বেপারীরা তাকে ধান সরবরাহ করেন। প্রতিবারে ২০ মণ ধান সরবরাহ করেন। আবহাওয়া ভাল থাকলে তারা কয়েকজন উদ্যোক্তা একত্রে সমন্বয় করে ১৫ দিনের মধ্যেই মুড়ি সরবরাহ করতে পারেন। লোকবল নিয়ে প্রতি বছর ১ হাজার মণ ধানের মুড়ি ভাজতে পারেন।
তিনি জানান, বাড়ি থেকে তিনি কিছু মুড়ি পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। পাইকারি কেজি ৮৫ ও খুচরা কেজি ১০০ টাকা বিক্রি করেন। ভালো মানের ধান হলে মূল্য বেশি হয়ে থাকে। ৪০ কেজি ধানে ২৩/২৪ কেজি মুড়ি হয়। একেক সময় একেক মূল্যের ধান সরবরাহ করা হয়। ধানের মূল্য সাধারণত ১৪০০ টাকা মণ হয়ে থাকে। ভাল মানের ধানের মূল্য ১৭/১৮০০ টাকা মণ হয়ে থাকে। প্রতিবারে আড়াইশ কেজি মুড়ি ডেলিভারি করতে পারেন।
দাম বেশি থাকায় এলাকায় হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা কম বলে জানিয়েছেন জৈনাতলী গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী আবুল হাসান। এগুলো সাধারণত রাজধানীতে সরবরাহ করা হয়। তাই আমরাও হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করি না। যাদের প্রয়োজন হয় তারা উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে কয় করেন। যন্ত্র দিয়ে তৈরি মুড়ি বিক্রি করেন ৭০ টাকা কেজি দরে।
এ বিষয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের শ্রীপুর ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে’র শাখা ব্যবস্থাপক শাহীনুর নাহার মৌরী বলেন, তৃণমূলের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া হয়। তবে এককভাবে সমিতির বাইরে কাউকে ঋণ দেওয়া হয় না। ঋণ গ্রহীতাদের ৪০ জনের একটি সমিতির আওতাভুক্ত হতে হয়। এর মধ্যে নারী ও পুরুষ সদস্যের অনুপাত হতে হয় অর্ধেক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঙ্খিত নারী সদস্য পাওয়া না গেলে সেখানে পুরুষ সদস্য দিয়েই সমিতি গঠন করা হয়। সমিতি গঠনের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থ বছরে পূরণ হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই