এক সময় খরা, অনাবৃষ্টি ও মঙ্গা পীড়িত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল নীলফামারীর জনপদ। বিগত কয়েক বছর থেকে দারিদ্র বিমোচন, খরা মোকাবেলায় কৃষকের কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্প। এই প্রকল্পের পানি বিভিন্ন খাল দিয়ে কৃষকের জমিতে পাঠানো হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় সেচ কার্যক্রম কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ায় কৃষি ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
চৈত্রের খরতাপেও টইটুম্বুর তিস্তা সেচ ক্যানেলের পানি। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার ক্যানেলে পানি উপচে পড়ছে। উজান থেকে ভাটিতে হু হু করে নেমে আসা পানি মূল ক্যানেল থেকে টারসিয়ারী, সেকেন্ডারি ক্যানেলের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে কৃষকের ফসলের মাঠে। শুষ্ক মৌসুমে এমন নিরবচ্ছিন্ন থৈ-থৈ করা সেচ সুবিধা পেয়ে প্রতিবছর রেকর্ড পরিমাণ জমিতে চলছে বোরো চাষাবাদ। স্বল্প খরচে, উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। নিবিড় পরিচর্যা আর সবুজের আলপনায় চলতি বছরও ভাল ফলনের আশা কৃষকের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। পরীক্ষামূলক সেচের মাধ্যমে প্রকল্পটি শুরু হয় ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে। এরপর ২০০৩ সাল থেকে সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে ১০ হাজার হেক্টর, ২০১৭ সালে ৮ হাজার হেক্টর, ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর, ২০১৯ সালে ৪০ হাজার হেক্টর, ২০২০ সালে ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়।
২০২১ সালে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পানির পর্যাপ্ততায় ৫৩ হাজার হেক্টরে সেচ প্রদান করা হয়। ২০২২ সালে ৫৩ হাজার হেক্টর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সেচ অব্যাহত রাখা হয়েছে। প্রতি বিঘা জমির সেচ সুবিধার জন্য কৃষদের পরিশোধ করতে হয় ১৬০ টাকা। এতে করে প্রতি একর জমির সেচের মূল্য পরিশোধ করতে হয় ৪৮০ টাকা। আর ওই সেচ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১২ উপজেলায় কাজ করছে ২৪২টি পানি ব্যবস্থাপনা সমিতি।প্রকল্পের পর্যাপ্ত পানি পেয়ে খুশি এলাকার কৃষকেরা।
কিশোরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের বাজেডুমুরিয়া ক্যানেল পাড়ের বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, এক সময় মাটির কুয়া, ঢেঁকিকল, ডোঙ্গা, সেউতির মাধ্যমে সেচ দিয়ে বিঘা প্রতি ধান পেতাম ৮-১০ মণ। তাছাড়া অধিকাংশ জমি সেচের অভাবে পড়ে থাকত। এখন সহজে ক্যানেলের পানি পেয়ে শতভাগ জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি হোসেন মো. সাদিকুল ইসলাম বলেন, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প না হলে প্রচণ্ড দাবদাহে এ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হত। মৎস্য, পশুপালন, বনায়ন ও যোগাযোগ ক্ষেত্রেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। সেচের পানিতে কৃষকেরা নির্বিঘ্নে আবাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেচ যন্ত্র চালিয়ে বোরো আবাদে প্রতি একরে খরচ হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। সেখানে সেচ প্রকল্পের পানিতে আবাদে খরচ হচ্ছে মাত্র ৪৮০ টাকা। খরচ কম হওয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষক।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, চলতি বোরো মৌসুমে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দিতে পারছে প্রকল্পটি। এতে করে নীলফামারীসহ পার্শ্ববর্তী রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২ উপজেলায় বাড়তি উৎপাদন হবে ৩ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন ধান। প্রকল্পের টারশিয়ারী ও সেকেন্ডারি মিলে ৭৬০ কিলোমিটার সেচ খালের মাধ্যমে এসব উপজেলায় সেচ প্রদান করা হচ্ছে।
তিস্তা সেচ প্রকল্পের রিজার্ভারে ৩ হাজার কিউসেকের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে। যা দিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ২৪২টি পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ভালো ফলনের জন্য পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর