স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন যাত্রী শূন্য হয়ে গেছে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ফেরি ঘাট। গত তিন দশক ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথটি অচিরেই বিলুপ্তি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ঘাট সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে নৌপথকে ঘিরে লঞ্চ ও স্পীডবোটসহ ঘাটে কয়েক হাজার শ্রমিক ও ব্যবসায়ী বেকার হয়ে পড়ছেন।
শনিবার সকালে বাংলাবাজার লঞ্চঘাটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চির চেনা কোন ভিড় নেই। নেই যাত্রীদের হৈ চৈ। দূর দূরান্ত থেকে যাত্রীবাহী পরিবহন বাসগুলো এসে থামছে না। গত তিন দশক ধরে প্রতিদিনের সেই চিরচেনা ঘাটের চিত্র খুজে পাওয়া গেল না। তিন নম্বর লঞ্চ ঘাটের গলিতে গিয়ে দেখা গেল, একটি খাবারের হোটেল ও একটি চায়ের খোলা রয়েছে। বাকি সব দোকানগুলো বন্ধ। একটু এগিয়ে লঞ্চ ঘাটের পন্টুনে গিয়ে দেখা গেল, ঘাটে সারি সারি করে বেঁধে রাখা হয়েছে প্রায় ৪০টি লঞ্চ। কারো চোখে মুখে কোন ব্যস্ততার ছাপ নেই। মুখগুলো সবার মলিন। ধুসর। একটি লঞ্চে স্থানীয় কিছু লোকজন পদ্মা পাড়ি দিতে উঠতে দেখা গেল। শিবচরের মাদবরচরের বাসিন্দা বশির মাদবর। তিনি ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন ঘাটে। তিনি বললেন, সেতু চালু হয়েছে। এখন এই ঘাটের তেমন গুরুত্ব নেই। মানুষ নেই, ঘাটের জৌলুসও নেই।
এই নৌপথের হাজী শরীয়তউল্লাহ লঞ্চের মাস্টার হানিফ হাওলাদার বলেন, ‘সারাদিন এই রুটের বাংলাবাজার ঘাট থেকে মাত্র ৩/৪ টি লঞ্চ ছাড়ে। আগে পনের মিনিটেই একটি লঞ্চ যাত্রীতে ভরে যেত। আজ সেখানে দুই ঘণ্টাতেও একশ জন যাত্রী হয় না। ’
এম.ভি শুভ এন্ড রোদেলা লঞ্চের কর্মী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখন বেকার হয়ে গেলাম। এখন কিভাবে সংসার চালাবো। কিস্তি চালাবো তা বুঝতে পারছি না।’
আরেকটি লঞ্চের চালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই নদীর সাথে গত তিরিশ বছর ধরে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলাম। এখন এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বেকার জীবন নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকবো। বুঝতে পারছি না। সরকারের কাছে আমাদের জন্য পুর্নবাসনের দাবি করছি।
এদিকে একই চিত্র স্পিডবোট ঘাটেও। সেখানেও নেই যাত্রী। তবে ফেরি ঘাট একেবারেই শূন্য। গত বছর পদ্মা সেতুর সাথে ফেরির একাধিক বার ধাক্কা লাগে। এরপর থেকেই বাংলাবাজার ঘাট থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফেরি চলাচলের নতুন ঘাট ঠিক করা হয় শরীয়তপুরের মাঝির ঘাট। সেখানেও যাত্রীদের চাপ নেই। কিছু মোটরসাইকেল পারাপার হচ্ছে ফেরিতে।
এমএল শাহিন লঞ্চের মালিক সাগর হাওলাদার বলেন, ‘সরকারের কাছে দাবি করছি, আমাদের লঞ্চগুলোকে নতুন নতুন রুটে চালানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হোক। যাতে আমাদের বেকার থাকতে না হয়।’
বাংলাবাজার ঘাটের বিআইডব্লিটিএ’র ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আখতার হোসেন বলেন, ‘১৯৯৬ সাল থেকে শিবচরের এই ঘাটটি চালু হয়। এরপর থেকে টানা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষদের এই ঘাট দিয়ে সেবা দেওয়া হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এই ঘাটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছে। তাই এখন যাত্রীদের চাপ আর থাকবে না। প্রতিদিন এই রুটে ৮৭ টি লঞ্চ ১৭ টি ফেরী ও দেড় শতাধিক স্পিডবোট চলাচল করত। সময়ের দাবি অনুযায়ী এখন সব নৌযানই সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।’
বাংলাবাজার ঘাটের লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘আমরা নতুন নৌপথ পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু এখনো কোন পারমিশন পাইনি।’
এই বিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় কেউ কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এই নৌপথের চালক শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। যাতে তারা কেউ বেকার না থাকে।’
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন